শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত টাঙ্গাইলের নদী-জলাশয়

লোহজং নদী। ছবি: স্টার

কয়েকটি শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত শিল্প বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে টাঙ্গাইলের কয়েকটি নদী, খাল এবং জলাশয়।

দূষিত হয়ে পড়া জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে মির্জাপুর উপজেলার বংশাই নদী, ঝিনাই নদী ও সোহাগপাড়া খাল এবং সদর উপজেলার লৌহজং নদী।

অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্যে নদী ও খালের পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে, সেখানে নেই কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব।

নদী ও জলাশয়গুলো স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল অফিস সূত্রে জানা যায়, মির্জাপুরে ডাইং ও প্রিন্টিং ইউনিট আছে এমন কারখানা আছে ১৪টি। বর্জ্য শোধনের জন্য এসব কারখানায় শোধনাগার বা ইটিপি রয়েছে।

কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, অধিকাংশ কারখানায় নিয়ম মেনে যথাযথভাবে এবং ক্ষমতা অনুযায়ী ইটিপি স্থাপিত হয়নি। এছাড়া কারখানা কর্তৃপক্ষ এগুলো ঠিকমতো চালায় না। ইটিপি চালানোর অতিরিক্ত খরচের কথা ভেবে তারা এগুলো অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখে এবং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি নদী বা খালে ফেলে।

মানবাধিকার কর্মী ও আইডিয়াল মির্জাপুর নামে একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আজাদ রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অধিকাংশ কারখানায় ইটিপি সংযোজনের বিষয়টি কেবলই লোক দেখানো। দীর্ঘদিন অপরিশোধিত বর্জ্য নদী, খাল এবং অন্যান্য জলাশয়ে ফেলায় সেগুলোর পানি বিষাক্ত হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’

পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদে এবং দূষণকারীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেও কোনো লাভ হয়নি, বলেও অভিযোগ করেন আজাদ।

স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করেন, এই পরিবেশ দূষণকারীরা প্রভাবশালী এবং তারা ঘুষ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হাতে রাখেন। এ ছাড়াও পরিবেশ ছাড়পত্র বা সনদ নবায়নের জন্যও মোটা টাকা পান কর্মকর্তারা।

অবৈধ দখল ও টানা দূষণে মৃতপ্রায় টাঙ্গাইল জেলা শহর দিয়ে প্রবাহিত লৌহজং নদী।

বিপুল পরিমাণ বর্জ্য, বিশেষ করে শিল্প কারখানার ক্ষতিকর শিল্প বর্জ্য একসময়ের স্রোতস্বিনী নদীটিকে গত দুই দশকে পরিণত করেছে বিষের নহরে। ধ্বংস হয়ে গেছে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, উজাড় হয়ে গেছে জলজ জীববৈচিত্র্য।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সদর উপজেলার তারটিয়া, গোসাইবাড়ি কুমুল্লী, ক্ষুদিরামপুর, করটিয়া ও বীরপুশিয়া এলাকায়। এসব জায়গায় নদীর পানির সঙ্গে স্থানীয় কারখানায় ব্যবহৃত কৃত্রিম রং মিশ্রিত পানির আলাদা আলাদা স্তর দেখা যায়।

ক্ষুদিরামপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রৌফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘দূষণের কারণে গোসল, কৃষিকাজসহ কোনো কাজেই আমরা এই নদীর পানি ব্যাবহার করতে পারি না। এই পানি পান করলে গবাদিপশুর ডায়রিয়া হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘অথচ একসময় এই নদীতে বড় বড় নৌকা চলত, আমরা গোসল করতাম, মাছ ধরতাম। স্থানীয় কৃষকরা নদীর পানি দিয়ে ফসলের খেতে সেচ দিতেন। কিন্তু সেসব আজ শুধুই অতীত। এখন নদীতে একটা ব্যাঙও খুঁজে পাবেন না।’

গোসাইবাড়ি কুমুল্লীর শামীম মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘স্থানীয় কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নদীর পানি এমনভাবে দূষিত করে ফেলেছে যে, পানির দুর্গন্ধে এলাকায় টেকাই দায়। কোনোভাবে এই দূষিত পানির সংস্পর্শে আসলে চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।’

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তারটিয়াতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে ১৯৮৩ সালে মোট ২৩ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বিসিক শিল্প এলাকা। পরে সেখানে কয়েকটি ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়। এর কয়েক বছর পর কাছাকাছি ক্ষুদিরামপুর এলাকায় আরও একটি টেক্সটাইল মিল স্থাপিত হয়।

স্থানীরা বলেন, এরপর থেকেই এই এলাকা দিয়ে যাওয়া লৌহজং নদীর পানি দূষিত হতে থাকে। বর্ষাকালে দূষিত পানি প্রবাহিত হয়ে চলে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি এলাকাতেই আটকে থাকে।

গত কয়েক বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর স্থানীয় কয়েকটি মিল কারখানাকে নদী দূষণের অভিযোগে জরিমানা করলেও নদী তার আগের চেহারা আর ফিরে পায়নি।

গোসাইবাড়ি কুমুল্লী গ্রামের আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা কী করি নাই? প্রতিবাদ, সমাবেশ, মানববন্ধন, প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ দায়ের। আর কত? কিন্তু কিছুই হয়নি।’

‘কারখানাগুলোর জরিমানা হোক, আমরা তা চাই না। আমরা চাই দূষণটা যেন বন্ধ হয়,’ রশিদ বলেন।

স্থানীয় কারখানাগুলোর দাবি, লৌহজং একটি প্রবাহহীন মৃত নদী এবং তারা কারখানার বর্জ্য ইটিপি দিয়ে পরিশোধন করেই নদীতে ফেলছেন।

তবে, স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ইটিপি ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় শুধু দিনের বেলায় কিছু সময় এগুলো চালানো হয়। কিন্তু রাতে পরিশোধন ছাড়াই পাইপ লাইনের মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়।

ইতোপূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় এসব কারখানা পরিদর্শন করে স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। তারা কয়েকটি কারখানাকে জরিমানা করা ছাড়াও তাদের ইটিপির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্র চন্দ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই ভয়াবহ নদী দূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দীর্ঘদিনেও মুক্তি না পেয়ে নদী তীরের বাসিন্দারা এখন হতাশ।’

এ ব্যাপারে বেলার পক্ষ থেকেও কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বলে বলে স্বীকার করেন গৌতম।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল অফিসের উপ-পরিচালক মুজাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ইতোপূর্বে নদী দূষণের অভিযোগে স্থানীয় কয়েকটি কারখানাকে একাধিকবার আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে আমরা শিল্প কারখানার দূষণের ব্যাপারে নিয়মিত নজরদারি বা দূষণের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও আমাদের এখানে পানি পরীক্ষার কোনো ল্যাবরেটরি নেই। স্থানীয় কারখানাগুলো থেকে নির্গত পানি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ঢাকার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এতে দূষণের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

Comments

The Daily Star  | English

What if India and China stop buying Russian oil?

Donald Trump is tightening sanctions loopholes that fund Moscow's war machine. What does a crackdown on Russia's oil trade mean for global markets — and economic heavyweights like China and India?

7h ago