সামারে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশা পর্তুগাল প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের
পর্তুগালসহ পুরো ইউরোপে ১ জুন থেকে শুরু হয়েছে গ্রীষ্ম বা সামার মৌসুম, যা আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকবে। লকডাউন তুলে নেওয়াসহ নানা বিধিনিষেধ শিথিল এবং করোনার গ্রিন পাসপোর্ট পরীক্ষামূলক চালুর মাধ্যমে পযর্টক আকর্ষণে সব প্রস্ততি নিয়েছে পর্তুগিজ সরকার। এতে বাংলাদেশিসহ পর্যটনশিল্পে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা করোনার ক্ষতি কাটিয়ে নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন। তবে হঠ্যৎ করে ইংল্যান্ডের 'সবুজ তালিকা' থেকে পর্তুগালকে সরিয়ে দেওয়ায় কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অ্যালগারভ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা।
ইউরোপে সামারে সূর্যের প্রখর আলো এবং দিনের আলো বেশিক্ষণ থাকার জন্য পুরো মানুষ বাইরের বেড়ানো, সূর্যস্নান উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এই সময় পর্যটকরাও ছুটে আসে। ফলে জমে উঠে পর্যটনশিল্পসহ সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য। মূলত গ্রীষ্মকেন্দ্রিক ব্যবসা দিয়ে পর্যটন শিল্প টিকে থাকে।
করোনাকালের আগে ২০১৯ সালে পর্তুগালে প্রায় ২৮ মিলিয়ন পর্যটক এসেছিল যার বেশিরভাগ ছিল সামার কেন্দ্রিক। পর্যটন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৮ ভাগের কাছাকাছি কিন্তু করোনার ভয়াল থাবায় গতবছর সামারে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো পর্যটকশূন্য ছিল পর্তুগালও। ফলে পর্যটন নির্ভর ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়ে। যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীও আছেন।
এবারে সামারে পর্যটন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশে অনেক আগে থেকেই পর্তুগাল সরকার উদ্যোগ নিয়েছে এবং গত মার্চ মাস থেকে ধাপে ধাপে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। এছাড়া ১৪ জুন থেকে চলমান বিধিনিষেধ আরও শিথিল হচ্ছে এবং প্রায় ৯০ শতাংশ প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
১৪ জুন থেকে রেস্টুরেন্টগুলো রাত ১টা পর্যন্ত খোলা রাখা এবং ভেতরে একসাথে ৬ জন এবং বাইরে ১০ জন বসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের নিয়মে ফিরে যাবে এবং মিউজিয়াম, সিনেমা হলগুলোতে ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগ দর্শক নিয়ে খোলা রাখা যাবে।
নিষেধাজ্ঞা শিথিলে পর্তুগালের পর্যটন অঞ্চল আলগারভে সমুদ্র স্নান শুরু হওয়ায় পর্যটকদের সুরক্ষায় এবং নজরদারির জন্য লাইফগার্ড নিযুক্ত করেছে। সমুদ্র স্নানের সুরক্ষা নিশ্চিতে এবং উদ্ধার তৎপরতা চালাতে অঞ্চলটির ২০০ কিলোমিটার উপকূলে প্রায় ৫১৪ জন লাইফগার্ড নিযুক্ত করেছে যারা আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে।
পর্তুগাল ইতিমধ্যে পর্যটক ও ইউরোপে যোগাযোগ সহজ করতে করোনার গ্রিন পাসপোর্ট পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছে, যা পুরো ইউরোপে আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। যাদের করোনার দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে তারাই গ্রিন পাসপোর্ট সুবিধা পাবেন।
অভিবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই পর্যটন সংশ্লিষ্ট খাতে যুক্ত আছেন। করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটক না থাকায় বিগত দেড় বছরে অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হন। আর যারা টিকে আছেন তারা এখন ভালো কিছুর প্রত্যাশায় আছেন। বিশেষ করে রাজধানী লিসবন বাণিজ্যিক ও ঐতিহাসিক পর্যটন নগরী পোর্তোর সুভেনির শপের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
লিসবনের সিটি সেন্টারে দীর্ঘদিন থেকে সুভেনির ব্যবসায় যুক্ত বাংলাদেশি ফারুক আহমেদ লিটন কাদেরী বলেন, ধীরে ধীরে ব্যবসা বাণিজ্যে গতিশীলতা ফিরতে শুরু করেছে তবে তা এখনো প্রত্যাশা থেকে অনেক কম। আশা করি সামনের দিনগুলোতে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য আরও বাড়বে।
পোর্তোর জাফরুল হাসান বলেন, ‘পর্যটক না থাকায় অনেকদিন বন্ধ রেখেছিলাম। বিধি-নিষেধ শিথিল করায় খুলেছি। আগের মতো ক্রেতা নেই। তবে পরিস্থিতি এখনকার মতো থাকলে হয়তো ভালো কিছু আশা করা যায়।
এদিকে সুরক্ষিত হিসাবে বিবেচিত দেশগুলির 'সবুজ তালিকা' থেকে পর্তুগালকে সরিয়ে নেওয়ার পর্তুগালের দক্ষিণের আলগারভ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। যখন পুরো অঞ্চলটি ব্রিটিশ পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল।
আগামী মঙ্গলবার ভোর ৪টা থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। ফলে পর্তুগাল থেকে ইংল্যান্ডফেরত সবাইকে ১০ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে এবং এই সময়ের মধ্যে ২ টি পিসিআর পরীক্ষা করতে হবে। ফলে অনেক ব্রিটিশ পর্যটক তাদের সফর বাতিল করছে, হোটেল রিজার্ভেশনগুলি বাতিল হচ্ছে।
গত ১৭ মে পর্তুগাল 'সবুজ তালিকা' তে প্রবেশের পর স্থানীয় পর্যটক ব্যবসায়ীরা শ্রমিক নিয়োগসহ অনেক কার্যক্রম বাড়িয়েছিল। এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা তাদের।
বরিস জনসনের নেতৃত্বে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়ে কড়া সমালোচনা করে "নিন্দা" জানিয়েছে, কমিউনিটি অফ দি অ্যালগারভের (এএমএল)। এএমএল-এর দৃষ্টিতে, এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় দেশগুলি জনগণের চলাচল এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অবদানের জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার সঙ্গে সাংঘষিক।
তারা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে ইংল্যান্ডকে রাজি করাতে পর্তুগিজ সরকারের কাছে আনুরোধ জানিয়েছে।
ব্রিটিশ পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ অ্যালগারভ অঞ্চলের ১৬টি পৌর শহরে প্রায় ২০০ জন অভিবাসী বাংলাদেশি পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় রয়েছেন। ইংল্যান্ডের এই সিদ্ধান্তে সবাই কিছুটা হতাশায় কিন্তু তারা আশাবাদী শিগগির এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে গতিশীলতা ফিরবে।
অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব হোটেল এবং টুরিজম এন্টারপ্রাইজ অব দ্যা অ্যালগারভ ব্রিটিশ পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পর্তুগালে আসার পর বাধ্যতামূলক পিসিআর পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি, এতে পারিবারিক ভ্রমণ অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ইউরোপের মধ্যে অন্যতম দেশ যেখানে সর্বাধিক করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের সুপারিশ, শুধুমাত্র সাধারণ একটি এন্টিজেন পরীক্ষার বিধান করলে কম খরচ ও সময়ে ব্রিটিশ পর্যটকরা তা করতে পারবেন। ইতোমধ্যে পাশের দেশ স্পেনে এটি কার্যকর হয়েছে।
পর্তুগালে ইতিমধ্যে প্রতি পাঁচ জনের একজন করোনার টিকা নিয়েছেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকহারে প্রয়োগের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুনে ৩০ বছর পর্যন্ত এবং আগস্ট মাসে ২০ বছরের সবাইকে টিকা দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
লেখক: পর্তুগাল প্রবাসী সাংবাদিক
Comments