টিকটক থেকে পাচার, ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

১৮ বছর বয়সী এক তরুণীকে দুই মাসের বেশি সময় ধরে কতটা নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, তা অনেকের কল্পনারও বাইরে।

গতকাল রোববার সায়মা (ছদ্মনাম) দ্য ডেইলি স্টারের কাছে তার টিকটক ভিডিও বানানো থেকে শুরু করে মানবপাচারকারীর কবলে পড়া এবং তারপর বিদেশে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো নির্যাতন সহ্য করার ভয়াবহ কাহিনী তুলে ধরেন।

এমনকি, যেটুকু সময় অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, ওই সময়টুকুও কোনো খাবার ছাড়া ছোট একটি অন্ধকার রুমে বন্দি থাকতে হয়েছে তাকে।

সায়মা ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ওই তিন বাংলাদেশি তরুণীর একজন, যারা পাচারকারী চক্রের কবল থেকে পালিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরতে পেরেছেন। ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

২০১৯ সালের মার্চে এক বন্ধুর মাধ্যমে রাজধানীর হাতিরঝিলে রিফাদুল আসলাম হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। হৃদয় টিকটকে হৃদয় বাবু নামে পরিচিত।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হৃদয় সায়মাকে নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে এক হ্যাংআউট পার্টিতে নিয়ে যান। একই বছরের সেপ্টেম্বরে গাজীপুরের একটি পুল পার্টিতেও নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ওই পার্টিতে ৭০০ থেকে ৮০০ তরুণ-তরুণী অংশ নেন।

কুষ্টিয়ায় আরেকটি হ্যাংআউট পার্টিতে অংশ নেওয়ার কথা বলে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি হৃদয় সায়মাকে ভারতে পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট সাতক্ষীরায় নিয়ে যান। সেখানে একটি বাড়িতে রাখা হয় তাকে। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় তার দুর্বিষহ কাহিনী।

সায়মাকে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের একটি বাড়িতে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে চক্রটি তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে।

পরে জাল ভারতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে চক্রটি তাকে উড়োজাহাজে করে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যায়। সেখানকার আনন্দপুরার একটি বাড়িতে ১০ দিন আটকে রাখা হয় তাকে। যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

ওই বাড়িতেই আরেক তরুণী রিংকির (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় তার। রিংকির ওপর চালানো নির্মম শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ভিডিওটিই সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে।

পরিচয়ের কিছুদিন পর রিংকিকে হায়দরাবাদের একটি হোটেলে পাঠিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। আর সায়মাকে নিয়ে যাওয়া হয় চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে।

কান্নায় ভেঙে পড়ে সায়মা বলেন, ‘আমাকে প্রথম দিন ১৯ জনের সঙ্গে যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়।’

ওই হোটেলে ছয় দিন থাকার পর সায়মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আনন্দপুরার বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে হৃদয় ও ঢাকা থেকে নতুন করে পাচার করে আনা আরও কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় তার।

সায়মা জানান, ওই বাড়িতে ও চেন্নাইয়ের হোটেলে তার সঙ্গে প্রায় প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন বাংলাদেশি তরুণীর দেখা হয়েছে।

‘যৌনকর্মে রাজি হলেই কেবল তারা আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে দিত’, বলেন তিনি।

গত ২৭ মার্চ হৃদয় সেখানকার একটি মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে চাইলে সায়মা বাধা দেন। সে সময় মদের বোতল দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন হৃদয়।

পরে হায়দরাবাদে থাকা রিংকির সঙ্গে ফোনে কথা বলে সায়মা পালানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং এ কাজে রিংকির সহায়তা চান। রিংকি তাকে বলেন, সায়মা যদি অন্য দুই তরুণীকে নিয়ে পালিয়ে কেরালা যেতে পারেন, তবে তিনি তাদের পালাতে সাহায্য করতে পারেন। তিনি নিজেও হায়দরাবাদেও হোটেল থেকে পালিয়ে কেরালা যাবেন। কেরালায় তার লোকজন আছে।

গত ৩ মে অন্য দুই তরুণী বেঙ্গালুরুর বাড়ি থেকে পালালেও অসুস্থতার কারণে সায়মা সেখানেই রয়ে যান। একদিন পর চক্রের সদস্যরা সায়মাকে চেন্নাইয়ের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পালাতে সক্ষম হন। অবশেষে গত ৭ মে সীমান্তে দালালদের ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছাতে পারেন তিনি।

ফিরে আসার পরপরই তিনি হৃদয়ের একটি ম্যাসেজ পান। রিংকিকে নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ভিডিও পাঠিয়ে হৃদয় তাকে হুমকি দেন, তার কথা মেনে না চললে এসব ভিডিও প্রকাশ করে দেওয়া হবে।

সায়মা বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ভিডিওটি আপলোড করি, যেন নিপীড়কদের গ্রেপ্তার করা হয়।’

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাফিজ আল ফারুক গতকাল ডেইলি স্টারকে জানান, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কিছু রাজ্যের বহুজাতিক এ চক্রটি মূলত সামাজিক যোগযোগমাধ্যম টিকটককে মানবপাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো টিকটক গ্রুপ, এগুলোর এডমিন ও এসব গ্রুপের সক্রিয় কিছু সদস্যকে চিহ্নিত করেছি, যাদের কার্যক্রম সন্দেহজনক। পাচারে জড়িত সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

আরও পড়ুন:

টিকটক ব্যবহার করে নারী পাচার যেভাবে

টিকটকে সক্রিয় আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্র: পুলিশ

তরুণীকে ধর্ষণ-নির্যাতন: বেঙ্গালুরু থেকে ৫ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতীয় পুলিশ

পালানোর চেষ্টাকালে পুলিশের গুলিতে ভারতে গ্রেপ্তার ২ বাংলাদেশি আহত

বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি নারী ধর্ষণ: ‘পালাতে গিয়ে’ গুলিবিদ্ধ আরও একজন গ্রেপ্তার

৫ বছরে ৫০০ তরুণী ভারতে পাচার, ‘মূল হোতা’ ‘বস রাফি’সহ গ্রেপ্তার ৪

পালিয়ে ফিরেছেন ভারতে পাচার ৩ নারী, বন্দি আরও অনেকে: পুলিশ

Comments

The Daily Star  | English
Asif Nazrul on Awami League’s political future

Filing of wholesale cases embarrassing for govt: Asif Nazrul

Law Adviser Asif Nazrul today said common people, particularly the political victims and rivals, are still filing wholesale cases against others since August 5, which is embarrassing for the current government

18m ago