স্বপ্নের বিচার
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা বর্তমানে যে অবস্থানে তাতে জমির মালিকানার প্রাথমিক স্বত্ব বুঝতে খুব বেশি কষ্ট পেতে হয় না। একজন মানুষ চেষ্টা করলে সহজেই অংক কষে সঠিকভাবে মালিকানা বুঝতে পারবে, দলিলপত্র ঘেঁটে।
দেশ গ্রামে এমন লোক হরহামেশাই পাওয়া যায় যারা জমি সংক্রান্ত এসব বিষয় খুব সহজেই বুঝতে পারে সমাধানও করতে পারে। জমির দলিল ঠিক আছে কিনা, কিংবা থাকলেও যিনি বিক্রি করেছেন তার নামে খতিয়ান ছিল কিনা, না থাকলে তার পূর্ববর্তীদের নাম ছিল কিনা, থাকলেও তা জাল কিনা, এক কথায় বিক্রেতার যে পরিমান জমি বিক্রি করেছে তার মালিকানা সমর্থনের কাগজ সঠিক ছিল কিনা তা বের করা এখন আর খুব বেশি জটিল নয়। তারপরও এ সংক্রান্ত সিভিল মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ কেন লাগে? কোনো ব্যক্তি বিশেষ এই কাজে নামলে হয়রানি হতে পারে কিন্ত কোর্টের পারা উচিত নিমেষেই। তারপরও বছরের পর বছর যুগের পর যুগ!
তার মূল কারণ হয়তোবা পাহারসম মামলার চাপ। কোর্ট কম, বিচারক কম, জনবল কম, উকিলের প্যাঁচ এতো এতো সমস্যার লাল সবুজ পাহাড়। আর তাই মামলা আর শেষ হয় না। একথা অনস্বীকার্য ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি, মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গলায় একটি রেশমি ফাঁস হয়ে রয়েছে তারপরও এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব প্রায় সব ক্ষেত্রেই কেননা এসব মামলার ভাগ্য নির্ধারিত হয় দলিলপত্র, স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতে। বিষয়টিকে জটিলভাবে দেখলেই জটিল আর সহজভাবে দেখলেই মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব দ্রুত।
মামলার ভুক্তভোগী মাত্রই জানে একটি থাকে মূল মামলা অন্যগুলো থাকে মূল মামলা থেকে উদ্ভুত শাখা মামলা। একটি আমের আঁটি থেকে যেমন অনেক ডাল পালা বের হয়ে বড় আম গাছ হয়ে আবার ফল ধরে, সিভিল মামলাও অনেকটা সেরকম। সমস্যা হচ্ছে আম হয় সুমিষ্ট, তার গাছ দেয় অক্সিজেন আর মামলার স্বাদ হয় তেতো। আর যেহেতু আমরা মামলার আঁটি রোপন বন্ধ করতে পারছি না তাই চারাগাছকে আগে বাছাই করতে হবে, বড় গাছের ডালপালা ছেটে দিতে হবে তাহলে আপনাতেই বন্ধ হবে ফলন।
চারা বাছাই (ফাইলিং সেকশন) মামলার কারণ অনুসন্ধান
জমি সংক্রান্ত সিভিল মামলার ফাইলিং সেকশন আলাদা হতে হবে, যা গঠিত হবে সহকারী জজদের প্যানেল দিয়ে। যাদের অধীনে থাকবে আলাদা সার্ভে টিম। স্ক্যানিং হবে প্রথমেই, মামলার কারণ সঠিক আছে কিনা কোর্টের তত্ত্বাবধানে যাচাই করা। কোর্ট, সাবরেজিষ্ট্রি অফিস আর ভূমি অফিসকে এক সুতোয় বাঁধতে হবে। প্রাথমিক ভাবে মামলা করার কারণ পেলে রিপোর্টসহ মামলার নথি চলে যাবে শুনানির জন্য নির্ধারিত কোর্টে। আর মামলা করার কারণ পাওয়া না গেলে কারণ উল্লেখপূর্বক সরাসরি খারিজ। ক্ষেত্র বিশেষে জরিমানা বা জাল দলিল দিয়ে মামলা করলে আইনানুগ ব্যাবস্থা। খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে একবারই আপিল করার সুযোগ পাবে বাদি জেলা জজের কাছে। আপিলে বাদী উত্তীর্ন হলে মামলা চলে যাবে শুনানির কোর্টে। আপিল ডিসমিস মামলা শেষ। এক্ষেত্রে চারাগাছ আর বড় হতে পারছে না।
ডালপালা ছাঁটা (বিবিধ সেকশন)
নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত শুনানির জন্য বিবিধ সেকশনে বিবিধ মামলা আকারে দরখাস্ত ফাইলিং করতে হবে। ফাইলিং সেকশনের রেজিঃভুক্ত মামলার নম্বর হতে উদ্ভুত বিবিধ মামলা হিসাবে রেজিঃভুক্ত হবে। মুল মামলা স্ক্যানিং এ খারিজ হলে বিবিধ মামলা খারিজ হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা হবে আদালতের প্রশাসনিক আদেশ মূলে। আর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে বা না দেওয়া হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার আগের বিধান থাকবে অপরিবর্তিত। সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজ এসকল বিবিধ মামলা শুনানি করবেন। ধাপে ধাপে এই মামলা যদি সুপ্রিম কোর্টেও অবস্থান করে মূল মামলা খারিজ হলে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপিল না করলে বিবিধ মামলা সরাসরি আদালতের প্রশাসনিক আদেশে খারিজ হয়ে যাবে। আর যদি মূল মামলা শুনানির জন্য গৃহিত হয়, বিবিধ মামলা চলে আসবে শুনানির কোর্টে, শুনানির কোর্ট প্রয়োজনবোধে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পুনরায় শুনানি করে বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি করবেন। বছরের পর বছর মূল মামলা থেকে উদ্ভুত শাখা মামলার রুল নিষ্পত্তির ভার থেকে উচ্চ আদালত রেহাই পাবে। উচ্চ আদালতে মামলার চাপ কমে যাবে দ্রুত কেননা একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে উচ্চ আদালতে এরূপ অনেক শাখা মামলা রয়েছে যার মূল মামলা নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে পূর্বেই। কেবল তথ্য না থাকার কারণে এমন মামলার বোঝা বহন করতে হয় উচ্চ আদালতের।
শুনানির আদালত: বাগান পরিচর্যা
গঠিত হবে যুগ্ম জেলা জজ দ্বারা। বিবাদীর লিখিত জবাব হবে কেবল রিপোর্টের উপর নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে। না দিলে রিপোর্টের ভিত্তিতে ইস্যু গঠন করে স্বাক্ষী নিয়ে মামলার স্বাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা সম্পূর্ণ করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে রায় প্রদানকারী আদালতে।
রায় প্রদানকারী আদালত: মহীরুহ কর্তন
যুক্তিতর্ক (লিখিত হবে) শুনবেন ও রায় প্রদান করবেন। আমলে নেবেন রিপোর্ট, লিখিত জবাব, জবানবন্দি, জেরা, যুক্তিতর্ক আর আদালত গঠিত হবে অতিরিক্ত জেলা জজ, জেলা জজ দ্বারা। রায় দেওয়ার সময় যদি কোনোভাবে রিপোর্টে মারাত্মক ভুল পাওয়া যায় তাহলে রায় প্রদানকারী আদালত বা ক্ষেত্র বিশেষে আপিল আদালত রিপোর্ট প্রদানকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করতে পারবে।
ডিক্রি জারী আদালত
সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজের দ্বারা গঠিত হবে। জারী মামলা হতে উদ্ভুত বিবিধ মামলা শুনানি করার এখতিয়ার থাকবে। রায় প্রদান করবে রায়ের জন্য নির্ধারিত আদালত।
একবার একটু ভাবুনতো আপনি আপনার গ্রামে একটি জায়গার মালিক। থাকেন ঢাকায়। আর এস খতিয়ানে আপনার বাবার নাম ছিল। বিএস খতিয়ানে নাম আসে নাই। এলাকার কিছু অসৎ লোক কোনো ভাবে জায়গাটিকে অন্য কারও নামে রেকর্ড করিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে আরেক ব্যক্তির কাছে। আপনি পরে জানতে পেরে যিনি কিনেছেন তার দলিল বাতিল চেয়ে মামলা করেছেন। ক্রেতা মিউটেশন করে নিয়মিত খাজনা দেয়। আপনি দুই মাস পরে কোর্ট থেকে একটি ইমেইল ও ফোনে মেসেজ পেলেন নির্দিষ্ট দিনে স্বাক্ষ্য দেওয়ার জন্য, একদিন পরে পেলেন একই বিষয়ে আদালতের নোটিশ। এর ভিতরে আপনি অসুস্থ হলেন। যেতে পারলেন না কোর্টে। আপনার আইনজীবীকে জানালেন আপনার অপারগতার কথা। এর দুই মাস পরে আরেকটি মেসেজ ও চিঠি পেলেন আপনি তখন প্রায় মৃত্যু শয্যায় এবার জানালো হল আপনার পক্ষে রায় হয়েছে। আপনি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা একটি কোডে জমা দিলে আপনার কাছে রায়ের কপি ইমেইল করা হবে। আপনি কেমন করে যেন সুস্থ হয়ে গেলেন। রায় হাতে পেলেন এবার জানলেন এলাকার কিছু অসৎ লোক অন্য মানুষকে আপনার পিতা সাজিয়ে বিক্রেতা হিসাবে একজনের নামে ক্রয় দেখিয়ে ছিলেন। ওই জনৈক ব্যক্তি তার নামে বিএস রেকর্ড করেন দলিল মূলে। যিনি পরবর্তীতে বিক্রি করেন বিবাদীর কাছে, বিবাদী আসলে প্রতারিত হয়েছেন। আপনি এত কিছুর-কিছুই জানতেন না কিন্ত আপনার হয়ে কোর্টকে জানিয়েছেন সাবরেজিষ্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস। আপনার আইনজীবীটিও ছিলেন করিৎকর্মা। কিছুদিন পরে এলাকায় গিয়ে জানতে পারেন পুরো টাউট চক্র এখন জেলে আর বিবাদীর খাজনা খারিজ বাতিল করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে দিব্যি আপনি এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। মাত্র চার মাসে মামলা খতম। এটাই "স্বপ্নের বিচার"।
এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
Comments