‘আগুনে বই পুড়েছে, স্বপ্ন নয়’

মহাখালীর সাততলা বাউন্ডারি বস্তিতে আগুনে পুড়ে যাওয়া বই দেখছেন চাঁদনী আক্তার। ৭ জুন ২০২১। ছবি: শাহীন মোল্লা/ স্টার

‘রাতে যখন আগুন লাগে তখন আমরা ঘুমাচ্ছিলাম। জীবন বাঁচাতে গিয়ে বাসা থেকে কোনোকিছুই সঙ্গে নিতে পারিনি। সকালে এসে দেখি বই-খাতা সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া বইগুলো হাতে নিয়ে এসব কথা বলছিলেন চাঁদনী আক্তার (১৯)। এ বছর মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন তিনি।

ছবি: শাহীন মোল্লা/ স্টার

মহাখালীর সাততলা বাউন্ডারি বস্তিতে একটি টিনের বাড়িতে তিন মেয়ে নিয়ে থাকেন দিনমজুর আবদুর রহিম। গত সোমবার ভোররাতে আগুনে বাড়িঘর সবই পুড়ে গেছে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আগুন এমন সময় লাগে যখন আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। পরে জীবন বাঁচাতে গিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ি। জিনিসপত্র কিছুই বের করতে পারি নাই। সব পুড়ে গেছে।’

আবদুর রহিমের তিন মেয়েই মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করছে। তার মেজ মেয়ে শ্রাবন্তী আক্তার এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে মিম আক্তার পড়ছে ক্লাস সেভেনে।

তিন মেয়েকেই নার্সিং পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন আবদুর রহিম। তাই বড় দুই মেয়েই বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করিয়েছেন। ছোট মেয়েকেও বিজ্ঞান বিভাগেই পড়ার কথা জানিয়েছেন।

বড় মেয়ে চাঁদনী বলেন, ‘কলেজের সবগুলো বই আমি জোগাড় করেছি। যতগুলো নোট দরকার সবকিছুই ছিল। এখন সব পুড়ে গেছে।’

তবে, মনোবল হারাননি চাঁদনি। বিএসসি নার্সিং ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তিনি।

ডেইলি স্টারকে চাঁদনী বলেন, ‘আমার আত্মবিশ্বাস আছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শেষ করেছি। হয়তো পরীক্ষার আগে যতটুকু প্রস্তুতি নিতে পারতাম এখন সেটা পারবো না। নোটগুলো আবারও জোগাড় করার চেষ্টা করবো।’

চাঁদনী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে ৪.২২ পেয়েছে পাশ করেছে। আবদুর রহিম জানান, খেয়ে না খেয়ে বহু কষ্টে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন তিনি।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘টাকার অভাবে মেয়েদের কাউকে প্রাইভেট পড়াতে পারিনি। পড়া বোঝার জন্য চাঁদনী কলেজের শিক্ষকের কাছে গিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস করেছে।’

আগুনে সবকিছু পুড়ে গেলেও আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী আবদুর রহিম। তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনোবল ভাঙেনি। কাজ করে হোক, পরিশ্রম করে হোক আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাই। মেয়েদের পড়াশোনা করাতে চাই।’

ঘরের পোড়া জিনিসপত্র- লোহার খাট, চেয়ার, টিন বিক্রি করে ২৬০০ টাকা পেয়েছেন তিনি। মাথার ওপরে ছাদ পেতে ৮০০ টাকা দিয়ে একটি ত্রিপল কিনেছেন।

কেন তিন মেয়েকেই নার্সিং পড়াতেন চান জানতে চাইলে স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বলেন আবদুর রহিম।

২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল তার স্ত্রী সাহেরা খাতুন ঢাকা মেডিকেলে মারা যান। জরায়ুর সমস্যা, রক্ত শূন্যতাসহ একাধিক রোগে ভুগছিলেন তিনি।

আবদুর রহিম বলেন, ‘স্ত্রীকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। কিন্তু যেরকম চিকিৎসা, ওষুধপত্রের কথা বলা হয়েছিল আর্থিক অনটনের কারণে সেটা দিতে পারিনি। শারীরিক জটিলতার কারণে সাত মাস গর্ভাবস্থায় ডাক্তার গর্ভপাত করাতে বলেছিলেন। অপারেশনের পরই তিনি মারা যান।’

তার বড় মেয়ে চাঁদনী বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুকে এখনও মেনে নিতে পারিনি। মা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। বস্তিতে থাকি বলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারি না। তাই নার্স হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।’

ছোট দুই বোনও একই কারণেই বিএসসি নার্সিংয়ে পড়ার কথা জানিয়েছে।

তাদের দাদি জাহানারা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হাসপাতালে গেলে দেখা যায়, নার্সরা মানুষের সেবায় কাজ করেন। মানুষের দুঃখ কষ্টে পাশে থাকেন। আমার নাতনীরা নার্স হয়ে মানুষের সেবা করবে সেটাই আমি চাই। মায়ের মৃত্যুর কারণে তারা যে কষ্ট পেয়েছে সেটা তাতে কিছুটা হলেও লাঘব হবে।’

আরও পড়ুন:

চতুর্থবারের আগুনে সব হারালেন স্বপ্না

মহাখালীর সাততলা বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে, কাজ করছে দমকল বাহিনীর ১৮ ইউনিট

Comments

The Daily Star  | English

Israeli strike hits military base south of Tehran

An Israeli attack on Saturday in Iran's west killed at least five army personnel and wounded nine others, Iranian media reported

48m ago