জেট ট্রেন: যে স্বপ্ন কখনো ডানা মেলেনি
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/train_9.jpg?itok=oChIoxPg×tamp=1623303568)
কানাডার রয়েছে বেশ কিছু সুদীর্ঘ রেলপথ, যেগুলো বিশাল আয়তনের প্রদেশগুলোকে সংযুক্ত করেছে। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কানাডার নেই কোনো দ্রুতগতির ট্রেন। সিএনএনের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে।
জি-৭’র সদস্য ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী সব রাষ্ট্রের মধ্যে কানাডাই একমাত্র দেশ যাদের রেললাইনের ওপর দিয়ে কোনো দ্রুতগতির রেলগাড়ি ছুটে চলে না।
তবে, জেট প্লেনের মতো ‘জেট ট্রেন’ প্রযুক্তির মাধ্যমে তারা দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল, যা একইসঙ্গে সারাবিশ্বের রেল শিল্পে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারত।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটির সবচেয়ে বড় যানবাহন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বম্বার্ডিয়ার একটি পরীক্ষামূলক, দ্রুতগতির যাত্রী বহনকারী রেলগাড়ির নকশা তৈরি করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করার মতো একটি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎচালিত আসেলা এক্সপ্রেস ও গ্যাস টার্বাইন হেলিকপ্টার ইঞ্জিনের প্রযুক্তির সংযোগে তৈরি জেট ট্রেন প্রকল্পটি একটি দ্রুতগতির ও আধুনিক যাত্রীবাহী রেলগাড়ি তৈরি করার সাহসী প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত।
বম্বার্ডিয়ারের প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছিল, দুটি করে প্র্যাট অ্যান্ড হুইটনি গ্যাস টারবাইন মোটর সমৃদ্ধ বগির মাঝে একটি যাত্রীবাহী বগি রাখা হবে এবং এর মাধ্যমে জাপানের এনইসি প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক রেলগাড়ির মতো আট হাজার হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের ক্ষমতা তৈরি হবে।
জেট ট্রেনের প্রোটোটাইপে ব্যবহৃত টারবাইন ইঞ্জিনটির ওজন ছিল মাত্র ৮৮২ পাউন্ড (প্রায় ৪০০ কেজি) এবং এর আকারটি অফিসে ব্যবহৃত ডেস্কের চেয়ে খুব একটা বড় ছিল না। একই ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ডিজেল ইঞ্জিনের ওজন কমপক্ষে ১০ টন (প্রায় ২২ হাজার ৪৬ পাউন্ড) এবং এটি ১৬ ফুট (চার দশমিক ৮৮ মিটার) লম্বা ও প্রায় ১০ ফুট উঁচু ছিল।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/train2.jpg?itok=fhrrUTNf×tamp=1623303604)
এক্ষেত্রে ইঞ্জিনের ওজন কম রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হালকা ইঞ্জিন ও রেলগাড়ি রেললাইনের ওপর কম চাপ সৃষ্টি করে এবং এতে সামগ্রিক পরিচালনা ও মেরামত খরচ কমে আসে।
এই ট্রেনটি ঘণ্টায় ১৬৫ মাইল (২৫৬ কিলোমিটার) বেগে চলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ডিজেল ইঞ্জিনভিত্তিক রেলগাড়ির চেয়ে এটি অনেকাংশেই হালকা ছিল এবং এর আধুনিক ইঞ্জিনটি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হওয়ার হারকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
মার্কিন ফেডারেল রেলরোড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফআরএ) নতুন, দ্রুতগতির রেল প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য একটি দরপত্র আহ্বান করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে বম্বার্ডিয়ার এই প্রোটোটাইপ বা নতুন প্রযুক্তির রেলগাড়ির নকশা ও পরিকল্পনাটি জমা দিয়েছিল। মূলত যেসব এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল, সেসব এলাকা দিয়ে এই ট্রেনটি যাতায়াত করার কথা ছিল।
এফআরএ ও বম্বার্ডিয়ার মিলে ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে প্রথম এবং একমাত্র প্রোটোটাইপটি তৈরি করেছিল নিউইয়র্কের প্ল্যাটসবার্গে অবস্থিত বম্বার্ডিয়ারের কারখানায়।
২০০০ সালে এটির কাজ শেষ হয় এবং পুয়েবলো, কলোরাডোতে এফআরএর পরীক্ষা কেন্দ্রে এটি ঘণ্টায় ১৫৬ মাইল গতিবেগ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়।
বম্বার্ডিয়ার ইউরোপে তখনকার জনপ্রিয় আন্তঃনগর ১২৫ মডেলের রেলগাড়ির পরিবর্তে তাদের জেট ট্রেন চালু করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, সেটি গৃহীত হয়নি।
২০০৪ সালে অরলান্ডো ও ফ্লোরিডার মধ্যে একটি জেট ট্রেন রেললাইন স্থাপন করার প্রস্তাব তহবিলের অভাবে বাতিল হয়ে যায়।
জেট ট্রেনকে যাত্রীসেবার উন্নয়নের জন্য আদর্শ সেবা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তবে, টেক্সাস থেকে লস এঞ্জেলস ও লাস ভেগাস পর্যন্ত জেট ট্রেনের চলাচল শুরু করার প্রকল্পগুলোও আলোর মুখ দেখেনি।
অপরদিকে, কানাডায় জেট ট্রেনকে ডিজেলচালিত আন্তঃনগর রেলগাড়ির বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে রেললাইন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ভিআইএ রেলের কুইবেক-উইন্ডসর রুটে জেট ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা তহবিলের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে।
২০০৮ সালে আবারও জেট ট্রেন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য আরেকটি নিরীক্ষা পরিচালিত হয়। কিন্তু, আজ পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই এবং এখনো জেট ট্রেনের প্রোটোটাইপটি পুয়েবলোতে সংরক্ষিত আছে।
ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি ও জ্বালানি তেল লবির প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দ্রুতগতির, নির্ভরযোগ্য ও নিয়মিত আন্তঃনগর রেলগাড়ি খাতে বিনিয়োগে অনীহা দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক বাস্তবসম্মত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু, কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি।
![](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/news/images/train3.jpg?itok=tkul0mh9×tamp=1623303699)
১০০ মাইলের চেয়ে বেশি গতিবেগ সম্পন্ন রেললাইন পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রেললাইন প্রতিস্থাপন, সিগনালিং প্রযুক্তি এবং রেলসেতু ও আন্ডারপাসের উচ্চ-ঝুঁকি সম্পন্ন গ্রেড ক্রসিংয়ের প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, যা ব্যয়বহুল।
১৯৭৬ সালের এপ্রিলে একটি সংস্কার কর্মসূচির পর কানাডার টার্বো-ট্রেনগুলো বর্তমানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৪০ দশমিক ছয় মাইল গতিতে চলতে পারছে, যা এই সেবার নির্ভরযোগ্যতা ও সময়মতো আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি আনতে পেরেছে। এই কর্মসূচির আগে সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৫ মাইল। প্রায় ৪৫ বছর পরে এসেও এ রেকর্ডটি ভাঙেনি, যা থেকে আমরা কানাডা সরকারের এ খাতে বিনিয়োগের অনীহার বিষয়টি সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি।
১৯৬০ সালের শেষের দিকে কানাডার যোগাযোগ প্রশাসন ‘ট্রান্সপোর্ট কানাডা’ কর্তৃপক্ষের মতে ‘যাত্রীবাহী রেলগাড়ি আর ঘোড়ায় টানা গাড়ির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই’।
দুঃখজনকভাবে প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষের চিন্তাধারায় খুব একটি পরিবর্তন আসেনি। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে বিনিয়োগের যোগ্য বলে মনে করা হচ্ছে না এবং এগুলোকে বাড়তি বোঝার মতো করে দেখা হচ্ছে।
১৯৭৮ সালে ভিআইএ রেল কানাডা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ৪০ বছরে আন্তঃনগর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো সম্প্রসারণ ঘটেনি। বরং এটিকে অনেকাংশে সংকুচিত করা হয়েছে।
কানাডার দ্রুতগতির জেট ট্রেনের স্বপ্নটি স্বপ্নই থেকে গেছে, ডানা মেলে ছুটে যেতে পারেনি ঘণ্টায় ১৫০ মাইল কিংবা তার চেয়েও দ্রুতগতিতে।
Comments