শ্রদ্ধাঞ্জলি

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বামপন্থী ছিলেন, দলপন্থী নয়

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত

খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে বাড়ির বারান্দায় পায়চারি করা জ্যোতি বসুকে ‘ভালোবাসা’ বারান্দা থেকে দেখা, লেক মার্কেটে দরদাম করে বাজার করা হেমন্তকে দেখা, বেণীনন্দন স্ট্রীটে সটান হাজির হয়ে ‘তবু মনে রেখ’র জন্যে সুচিত্রাকে আবদার করা মানুষটা চলে গেলেন।

‘শাঁটুল গুপ্ত’ পোশাকি নামধারী রাধাপ্রসাদ গুপ্তদের প্রজন্মের শেষ বাঙালি, যিনি অন্য প্রাণের কলকাতাকে চেটেপুটে জানতেন, চিনতেন- সেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর বিস্তৃত ছিল বাঙালি জীবনের অন্ধিসন্ধির গহীনে।

এক পাগলের মৃত্যুর পর তাকে স্বর্গের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার সিঁড়ির ধাপগুলো কেমন হবে, গোলগোল, ত্রিভুজাকৃতি নাকি চতুর্ভুজ? এসব দেখে বড় হওয়া বুদ্ধদেব জীবনের অন্তহীন জাগরণকে দেখেছিলেন যেন শঙ্খ ঘোষের বুড়িদের জটলার আঙ্গিকে। আর সেই দেখাকেই প্রতিফলিত করেছিলেন নিজের কবিতায় আর সিনেমায়। সেই প্রতিফলন সূত্রেই তার প্রথম প্রেম কবিতা না সিনেমা ছিল, তা হলফ করে বলা খুব কঠিন।

পুরুলিয়ার আনাড়াতে জন্ম হলেও তার শেকড় যে ঢাকার বিক্রমপুরে, সেটা তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। তাইতো, ‘সাহিত্য আকাদেমি’ প্রযোজিত অন্নদাশঙ্কর রায়ের জীবনভিত্তিক তথ্যচিত্র ‘সিংহাবলোকনে’র শুটিংয়ের সময় প্যাকঅ্যাপের পর শান্তিনিকেতনে বসে বাংলাদেশের মাঠ-প্রান্তরের কথা ছাত্রের মতো শোনা ছিল বুদ্ধদেবের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ। ছোটবেলায় হাজরা রোডে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের কাছ থেকে খাওয়া বাখরখানির স্বাদ আর গল্প তিনি শেষদিন পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। আড্ডায় বসে বাকরখানির স্বাদ ঘিরে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তার রসিকতার স্বর হয়তো কলকাতা মহানগরীর বুকে জেগে থাকবে আরও অনেক সন্ধ্যার আসরে।

রেলওয়ে কলোনির কসমোপলিটন সমাজে বড় হয়ে বৈচিত্র্যের তারুণ্যের ভেতরে বুদ্ধদেব নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। উত্তাল কলকাতাকে উপলব্ধি করলেও, সেই শহরে বেড়ে না ওঠায় তিনি রীতিমতো গর্ববোধ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শহুরে সঙ্কীর্ণতা মনের বিকাশকে সার্বজনীন করতে পারে না। বুদ্ধদেবের আত্মিক উপলব্ধি ছিল, পুরুলিয়ার আনাড়ার মিশ্র সংস্কৃতি কিংবা বিন্ধ্য পর্বতমালার কাছে মনীন্দ্রগড় তার মননলোকের উদঘাটনে জাদুকাঠি হয়ে উঠেছিল। সেই পরশ না পেলে তিনি চিন্তার ব্যাপ্তি ঘটাতে পারতেন না, মননশীলতার প্রসারণ সম্ভব হতো না।

মনীন্দ্রগড়ে একদিকে রাতে বাঘের ডাক ভেসে আসা, আরেকদিকে ছেলেকে খাঁটি দুধ খাওয়ানোর তাগিদে মায়ের গরু কেনা; সেই গরুর দেখভালের জন্যে সুখলালকে রাখা; সুখলালের কাছ থেকে শিশু বুদ্ধদেবের মনের আকাশ রঙিন হয়ে ওঠা; জঙ্গলে আগুন, সেই আগুনে ভালোলাগা ও ভয়লাগা- বুদ্ধদেব নিজেই বলেছিলেন, ছোটবেলাটা ওই রকম না হলে আমার খুব অসুবিধা হতো।

নিজের মধ্যে নিজে একা না হলে সৃষ্টিকে ব্যাপ্ত করা যায় না- এই বিশ্বাস থেকেই নিজের সবকিছুকে মেলে ধরতেন বুদ্ধদেব। তার বিশ্বাস ছিল, নিজের সঙ্গে নিজের সংযোগ, সেখানে আর কেউ নেই। পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, প্রেমিকা, সেলফোন, টেলিভিশন, অনুরাগী কেউ নেই। এমন হলে তবেই সৃষ্টির শিরা-উপশিরার সার্বিক উন্মোচন হয়। এই একাকীত্বের সঙ্কট যে অনেক সময়েই সৃষ্টিকে কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠার পথে বাধার জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ায়- এই বোধটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে একটু বেশিই তাড়িত করতো। একা থাকলে একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে পৌঁছানো যায়- এই প্রত্যয়ের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি তার সব সৃষ্টির ধারা-উপধারাগুলোকে মেলে ধরতে পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা নিজের সঙ্গে যদি নিজে দেখা না করতে পারি, তাহলে অপরের সঙ্গে দেখাটাও অসম্পূর্ণই থেকে যায়। তাই অন্নদাশঙ্করের কাছে শান্তিনিকেতনে বসে বিলেতি লেখকদের টেলিফোনের কথা শুনতে পেয়েই আনন্দে ফেটে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব। অন্নদাশঙ্কর বললেন, ‘কেউ বিরক্ত করতে পারে না তখন সেখানে লেখকদের। কারণ, লেখকরা ফোন করতে পারেন। কেউ পারে না লেখককে ফোন করতে।’ উত্তেজিত বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস টেলিফোনের যন্ত্রণা সইতে হতো না নিত্যকালে রবীন্দ্রনাথকে।’ আর সেই স্মৃতি একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তাকে উসকে দেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘ভাবো তো, মুহুর্মুহু মোবাইলে ফোন আসছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। কী অবস্থা বেচারার!’

বুদ্ধদেবের মায়ের পরিবার দেশভাগের পর কলকাতায় আসেন। ঢাকা শহরে মায়ের বাপের বাড়ি যে বিদেশি দূতাবাস হয়েছে, সেটা মনে রেখেই কবিতার ভুবনকে পরিপূর্ণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন-

রাত্রি আরও

ঘন হলে পেয়ারা বাগানে

গাঢ় ও গহন শীত নামে।

বুড়ো ঘোড়া জানলার পাট খুলে

ঘরের ভেতর উঁকি মারে, দ্যাখে

তার মাদী ঘোড়া কাদা হয়ে গ্যাছে

কাল ঘুমে।

তাই বুদ্ধদেবের কাছে জীবন মানে ছিল,

জীবন শুধুই কাদা কাদা- এই বলে

বুড়ো ঘোড়া আকাশের দিকে ছোটে।

হয়তো এভাবেই জীবনের পূর্ণচ্ছেদকে ধরতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব।

কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ সেই ভাসমান জীবনের ভাসমান চিত্রমালার কোলাজ ছিল। হয়তো কমলকুমারের সৃষ্টির অন্তর্ভেদী চিত্রকল্প শৈশব-কৈশোরে হাজরা রোডে ছিন্নমূল মামার বাড়ির সেই উঁচুতলার বাসিন্দা পাগলিনীর সঙ্গে নীচতলার ঘুটেকুড়োনীর সংলাপের ঘনঘটার আবর্তে মিলেমিশে যায়। লালনের মতোই সেই পাগলিনীকে দাহ করা হবে, না গোরে দেওয়া হবে, শ্রাদ্ধ হবে, না কি কুলখানি- এই তর্কের মধ্যেই বেড়ে ওঠা বুদ্ধদেব আত্মস্থ করেছিলেন বেঁচে থাকার অর্থ।

চেতনায় বুদ্ধদেব বামপন্থী ছিলেন। তাই বলে কখনো তিনি দলপন্থী ছিলেন না। বামপন্থীই হোক বা ডানপন্থী, কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে কখনও তিনি নিজের মেরুদণ্ডটা বন্ধক রাখেননি। কোনো দলের কাছে নিজেকে বিকিয়ে না দিয়েও কী করে একজন প্রকৃত বামপন্থী সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হয়ে উঠতে পারেন, গণতন্ত্রের উপাসক হতে পারেন, মানবতার সেবক হতে পারেন, ফ্যাসিবাদের শত্রু হতে পারেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তা দেখিয়ে গেছেন। দেখিয়ে গেছেন তার গোটা জীবন, জীবন-স্রোতে তৈরি সিনেমা আর কবিতার ভেতর দিয়ে।

 

গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago