ছোট ছেলেকে খুনের দায় বড় ছেলের ঘাড়ে, এক অসহায় বাবার দুঃসহ অভিজ্ঞতা

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ার কাটাখালি গ্রামের একটি পাটখেত থেকে উদ্ধার করা হয় মহিদুল ইসলামের ছেলে সোহাগের মরদেহ। আট বছর বয়সী ছোট ছেলের এ মৃত্যু শোক সামলে ওঠার আগেই আরেক বিপর্যয় নেমে আসে মহিদুলের জীবনে। ভাইকে হত্যার দায়ে তার বড় ছেলে সৌরভকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
Bogura_DS_Map
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ার কাটাখালি গ্রামের একটি পাটখেত থেকে উদ্ধার করা হয় মহিদুল ইসলামের ছেলে সোহাগের মরদেহ। আট বছর বয়সী ছোট ছেলের এ মৃত্যু শোক সামলে ওঠার আগেই আরেক বিপর্যয় নেমে আসে মহিদুলের জীবনে। ভাইকে হত্যার দায়ে তার বড় ছেলে সৌরভকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।

১২ বছর বয়সী সৌরভকে শুধু ভাই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারই দেখানো হয়নি, তার কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ দিনমজুর মহিদুলের।

গত বুধবার তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘খুনীরা প্রভাবশালী। পুলিশ তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছে। আমার ছোট ছেলে মো. সোহাগকে খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বড় ছেলে সৌরভ মিয়াকে বাধ্য করা হয়েছে।’

সৌরভের জবানবন্দি রেকর্ড করার পর তাকেই একমাত্র অভিযুক্ত দেখিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। কিন্তু, মহিদুল এতে নারাজি দিলে, ২০১৭ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)  মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেন আদালত।

পিবিআইয়ের চার বছরের তদন্তে সৌরভ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। পিবিআই খুনের সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তারও করতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।

বগুড়া পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) এবং মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনসুর আলী বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় সৌরভের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাইনি। এমনকি, ঘটনার সময় সে ঘটনাস্থলের ধারেকাছেও উপস্থিত ছিলো না।’

তাহলে স্থানীয় পুলিশ কীভাবে ওই চার্জশিট দিয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি তারাই ভালো বলতে পারবে।’

২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট সোহাগের মরদেহ উদ্ধারের একদিন পর সারিয়াকান্দি থানায় মামলা করেন তার বাবা মহিদুল। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর হঠাৎ করেই স্থানীয় থানার একদল পুলিশ তার বাড়িতে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলে সৌরভকে নিয়ে যায় তারা।

‘আমরা পুলিশের সঙ্গে থানায় যাই। কিন্তু, মামলাটির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমার আমাকে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে দেননি’, অভিযোগ করেন মহিদুল।

তিনি বলেন, ‘ছেলেকে দেখতে না পেলেও আমরা তার চিৎকার শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলে এবং পরদিন আদালতে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে বলে।’

পরদিন ৩০ নভেম্বর পুলিশ সৌরভকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে। সেখানেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে। বাবা-মা সোহাগকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসায় তাকে খুন করেছে বলে জানায় সৌরভ।

অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন এবং পরিবারের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেন। কিন্তু, সন্দেহভাজন হিসেবে প্রতিটি শুনানিতেই উপস্থিত থাকতে হয়েছে সৌরভকে

প্রকৃত খুনি কারা?

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআই জানতে পারে, তৌহিদুল ইসলাম (৩৫) ও তার ফুপাতো ভাই বিল্লাল হোসেনকে (৪০) খুনের দিন ঘটনাস্থলের আশেপাশে দেখা গেছে।

গত বুধবার এসআই মনসুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘খুনের পর তৌহিদ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান এবং চট্টগ্রামে কাজ করতে শুরু করেন। পুনরায় তদন্ত শুরু হওয়ার পর বিল্লালও গা ঢাকা দেন। তবে, প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা তাদের গ্রেপ্তার করতে পেরেছি।’

চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার তৌহিদকে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর বগুড়া আদালতে হাজির করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার সময় তৌহিদ জানান, ছেলের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে সোহাগের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন তিনি।

‘বিষয়টি আমার ফুপাতো ভাই বিল্লালকে জানাই। শিশুটিকে পাটখেতে নিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি আমাকে। সন্ধ্যায় আমি সোহাগকে সবজি তুলে দিতে বললে সে রাজি হয়। তখন তাকে খেতে বিল্লালের কাছে নিয়ে যাই এবং ফিরে আসি। পরে রাত সাড়ে আটটার দিকে সেখানে সোহাগের মরদেহ পাওয়া যায়’, আদালতকে বলেন তিনি।

গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বিল্লালকে আদালতে হাজির করে পিবিআই।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বিল্লাল জানান, সোহাগের বাবার একটি মরিচ খেত আছে। বিল্লালের ছাগল একদিন সেই খেতের গাছ খেয়ে ফেলায় মহিদুল তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। তাকে চড়ও দেন মহিদুল।

তিনি বলেন, ‘তৌহিদের রাগের ব্যাপারে জানার পর ওইদিন সোহাগকে খেতে নিয়ে যেতে বলি আমি। সোহাগ যাওয়ার পর আমি তার দুই পা ধরে রাখি এবং তৌহিদ গলা চেপে ধরেন। তার গায়ে কাস্তে দিয়ে কোপও দেন তৌহিদ।’

পিবিআই বগুড়ার পুলিশ সুপার আকরামুল হোসেন বলেন, ‘আমরা সৌরভের কোনো সম্পৃক্ততা পাইনি। তদন্ত প্রায় শেষ। শিগগিরই নতুন অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’

যা বলছে স্থানীয় পুলিশ

প্রথম অভিযোগপত্র দাখিলকারী সারিয়াকান্দি থানার সাবেক এসআই নয়ন কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দ্য ডেইলি স্টার। নয়ন বর্তমানে নাটোরে সিআইডির পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।

তিনি বলেন, ‘থানায় আমাদের অনেক কাজ থাকে। আর পিবিআই মামলাটি চার-পাঁচ বছর ধরে তদন্ত করেছে। নতুন ফলাফল আসতেই পারে। আমি আমার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলাম।’

এক প্রশ্নের জবাবে নয়ন বলেন, ‘ সৌরভের জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন আদালত। আমি এ ব্যাপারে কারো কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিইনি।’

কোনো শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার আগে এ বিষয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যুক্ত করা উচিত বলে মত দিয়েছেন পুলিশের উপমহাপরিদর্শক এবং পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।   

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago