মুক্তিযুদ্ধ

১৩ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে: তাজউদ্দীন আহমদ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ জুন বহুল ঘটনাবহুল ও আলোচিত একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বলেন, 'গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি আত্মমর্যাদাবান জাতি হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই। এই উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়াই করছে। প্রয়োজনীয় অস্ত্র পেলে ইনশাআল্লাহ আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অচিরেই দেশ থেকে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবেন।'

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ জুন বহুল ঘটনাবহুল ও আলোচিত একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বলেন, 'গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি আত্মমর্যাদাবান জাতি হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই। এই উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়াই করছে। প্রয়োজনীয় অস্ত্র পেলে ইনশাআল্লাহ আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অচিরেই দেশ থেকে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবেন।'

তাজউদ্দীন আহমদ তার ভাষণে স্বাধীনতা যুদ্ধকে অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আমি আহ্বান জানাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবেই। বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই দেশের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকে উৎসারিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দখলদার শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন শত্রুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী সুপরিকল্পিত হত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদের মানুষ ও সভ্যতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদ সরকারকে কোনো সাহায্য না দেয়ার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, ইসলামাবাদকে সাহায্যদান মানেই পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সে শক্তি কেবল বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই ব্যবহৃত হবে।এখন জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানবাধিকারকে বর্বরোচিতভাবে দমন করে জেনারেল ইয়াহিয়া ইসলামের দোহাই দিচ্ছেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে বিবৃতি

১৩ জুন লন্ডনের মার্কিন দূতাবাসের সামনে বাংলাদেশ যুব সংঘের উদ্যোগে হাজারখানেক প্রবাসী বাঙালি বিক্ষোভ প্রদর্শন করে মার্কিন দূতাবাস ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে স্মারকলিপি দেন। ওই স্মারকলিপিতে প্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তানকে অতিসত্বর সব ধরনের সাহায্য বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া অস্ত্র দিয়ে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালানো হচ্ছে। পূর্ববঙ্গে কী হচ্ছে তা কল্পনাতীত। ৫০ লাখের বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সাধারণ নিরীহ মানুষদের উপর গণহত্যা চালিয়ে গোটা দেশ অস্তিত্বশূন্য করে দেয়া হয়েছে। আর এর আগে গণতন্ত্রকে কবর দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের অবশ্যই এই অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিছু করার আছে।

১৩ জুন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নেতা মওলানা আবুল আলা মওদুদী লাহোরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'আমাদের সম্মান বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখের ওপর তাদের সাহায্য ছুড়ে দিয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য করা উচিত পাকিস্তান সরকারের। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে।'

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ

ব্রিটেনের প্রখ্যাত সংবাদপত্র সানডে টাইমস ‘দুঃখের মিছিল’ শিরোনামে একটি উপ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই উপসম্পাদকীয়তে শরণার্থীদের দুর্দশা ও কষ্টের মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়, ‘ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তের একটি শহর বারাসাত। এর স্বাভাবিক জনসংখ্যা হলো ২১ হাজার। এখানকার হাসপাতালটি কোনো রকমে এই অধিবাসীদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু গত সপ্তাহে দেড়-দুই লাখ লোক বন্যার মতো বারাসাত শহরে ঢুকেছে। তারা শহরের চারপাশে ফসলের খেতে জড়ো হয়েছে। স্কুল, কলেজ, সিনেমা হলে এবং পতিত জমিতে এদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোথাও জায়গা নেই আর। হাসপাতালের পিছনের দিকে একটি কক্ষে কলেরা বিভাগ। এখানে কোনো বিছানা নেই। পাকা মেঝের ওপর ধাতব পাতে রোগীরা শোয়। অজস্র শরণার্থী মারা গেছেন গত কয়েকদিনে কলেরায় ভুগে। টিকা, ঔষধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি এখানে অপ্রতুল। আমরা দেখলাম চার জন লোক মৃতদেহগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। এই জায়গাকে বলা যায় মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস। অথচ এখানে বাস করেও শরণার্থীরা বলছে, 'আমরা যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে থেকে এগিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের সমস্ত কিছু ধ্বংস করেছে মিলিটারি। এখন অন্তত প্রাণ নিয়ে তো থাকতে পারছি।’

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

গোলাহাট গণহত্যা

১৩ জুন পাকিস্তানি হানাদারেরা নীলফামারীর সৈয়দপুরে আশ্রয় শিবির থেকে অবাঙালি মাড়োয়ারি ও হিন্দু পরিবারদের ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে একটি ট্রেনে তোলে। সকাল ১০টার দিকে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় ট্রেনটি। চলছিল ধীরে ধীরে। শহর থেকে বেরিয়ে রেলওয়ে কারখানা পেরিয়েই হঠাৎ থেমে যায় ট্রেন। জায়গাটা স্টেশন থেকে দুই মাইল দূরে। জায়গার নাম গোলাহাট। বাইরে সারি সারি পাকিস্তানি হানাদার সেনা। সঙ্গে তাদের দোসর বিহারিরা। সেনা সদস্যদের হাতে রাইফেল। আর বিহারিদের হাতে ধারালো রামদা। এরপর ট্রেনের প্রতিটি বগির দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ২/৩ জন করে নামিয়ে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। এ পৈশাচিক গণহত্যায় শহীদ হন ৪৪৮ জন। মাত্র ১০ জন সেদিন বাঁচতে পেরেছিলেন এই পৈশাচিক গণহত্যা থেকে।

১৩ জুন মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনী শেরপুরের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে ৫০ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র দখল করে।

১৩ জুন টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাসাইল থানা আক্রমণ করে। এ সংঘর্ষে একজন দালাল ও একজন দারোগা নিহত হয় প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ বাসাইল থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে।

১৩ জুন কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা রাজাপুর রেলস্টেশনের পাশে পাঁচড়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে হানাদারদের ১১ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়।

১৩ জুন খুলনার সাদীপুর ও শাখরা নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।

তথ্যসূত্র- 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ১৪ জুন ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৪ জুন ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

 

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago