বাংলার বর্ষা, প্রকৃতির সঞ্জীবনী
আজ বর্ষার প্রথম দিন। গ্রীষ্মের রুক্ষ খরতাপে সবার প্রাণ-মন যখন ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই আগমন ঘটে বর্ষার। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড খরতাপে রুক্ষ প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে বর্ষার বর্ষণের মৃদঙ্গ ছোঁয়ায়।
আচ্ছা ঋতুরাজ যদি বসন্ত হয়, ঋতুরাণী কে? উত্তরটা নিঃসন্দেহে বর্ষা! বর্ষাকে প্রকৃত অর্থেই বলা হয় প্রকৃতির রাণী। চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠের খরতাপে যখন সমস্ত মর্ত্যের চতুর্দিকে উষ্ণতায় প্রাণ অতিষ্ঠ, ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই নেমে আসে গভীরতম স্বস্তি। প্রকৃতির বুকে ফিরে আসে প্রশান্তি। তাইতো তার ভোর নেই, প্রভাত নেই, মধ্যাহ্ন নেই, নেই তার অপরাহ্ণ, সাঁঝ কিংবা গভীর নিশি, অঝোর বারিধারায় কেবলই বর্ষণের ধ্বনি। খরতাপ ভেঙে এই যে রাণীর আগমনী, তার শ্লোক যেন বাজে প্রকৃতিতে।
এমন দিনেই খুলে যায় সকল প্রাণ, বলা যায় নিঃসঙ্কোচে, তাইতো আমরা আপন মনেই গাইতে থাকি বর্ষার গান।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
"এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়—
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে তপনহীন ঘন তমসায়॥"
রবীন্দ্রনাথ তো সর্বাগ্রে। বর্ষাকে বাংলা সাহিত্যে ও মন জাগরণে নিপুন হাতে তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথই। তার বর্ষাবন্দনা এতই সমৃদ্ধ যে বাংলা সাহিত্যে এমন বর্ষাবন্দনা মেলা ভার। তাই বর্ষা উদযাপনে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত কোনো বিকল্প নেই।
রবীন্দ্রনাথের গানের সংকলন গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গান আছে ২৮৩টি। এর মধ্যে বর্ষা পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০টি।
বর্ষার সঙ্গে অন্য ঋতুর তুলনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা একমাত্র। তাহার জুড়ি নাই। গ্রীষ্মের সঙ্গে তাহার মিল হয় না; গ্রীষ্ম দরিদ্র, সে ধনী। শরতের সঙ্গেও তাহার মিল হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কেননা শরৎ তাহারই সমস্ত সম্পত্তি নিলাম করাইয়া নিজের নদীনালা মাঠঘাটে বেনামি করিয়া রাখিয়াছে। যে ঋণী সে কৃতজ্ঞ নহে।’
বৃষ্টি কিংবা ঝড় শুরু হলে আমারা রবীন্দ্রনাথের গানেই আশ্রয় খুঁজি।
রবীন্দ্রনাথ তার ১৩২১ বঙ্গাব্দে আষাঢ় মাসের কোনো এক দিনে ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা না-একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন ঋতু যে নিতান্ত বিনা কারণে তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে তাহা যদি দেখিতে চাও তবে সঙ্গীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেন না, সংগীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে। বলিতে গেলে ঋতুর রাগ-রাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীতশাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব, কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই, বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার; আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরো বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে, বর্ষারই হয় জিত।”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "বর্ষা কবিদের ঋতু।" রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের সত্যতা তার নিজের বেলায়ও প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতুও বর্ষা। কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়; কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসুর মতো কবিদের প্রিয় ঋতুও ছিল বর্ষা।
নজরুলও কম যান না। নজরুলের 'শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।', 'এসো হে সজল শ্যামল ঘনদেয়া’, ‘এসো স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেণী-বর্ণা-মালবিকা’, ‘কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের বাঁশি’, ‘ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন’, ‘চঞ্চল শ্যামল এলো গগনে’, ‘বরষা ঋতু এলো এলো’, ‘মেঘলামতির ধারাজলে করো স্নান’, ‘মেঘের হিন্দোল দেয় পূর্ব হাওয়াতে দোলা’, ‘দুলবি কে আয় মেঘের দোলায়’, ‘বাজে মৃদঙ্গ বরষার’, ‘রুম ঝুম ঝুম বাদল নূপুর বাজে’, ‘রুমঝুম রুমুঝুমু কে এলে নূপুর পায়’ এর মতো অনেকগুলো বর্ষার গান আছে। নজরুল বর্ষাকে তুলনা করেছেন "প্রিয় বিরহ" এর সাথে।
বলে রাখা ভালো বর্ষার পদ কিন্তু কেবল রবীন্দ্রনাথের হাতেই সূচনা হয়নি। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাসের মতো কবিরা বর্ষা বিরহ ও বর্ষা অভিসারের অনেক পদ রচনা করেছেন। তাদের কাব্যে বর্ষার সাথে প্রেম ও বিরহ শব্দ দুটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষায় বর্ষার আদি কবি কালিদাস তার "মেঘদূত" কাব্যে বর্ষামাধুর্য, বিরহের যে সজল কোমলতা বর্ণনা করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।
পদাবলী সাহিত্যে বর্ষার পদগুলো যদি আমরা দেখি প্রথমে দেখবো মিথিলার কবি বিদ্যাপতির বর্ষা বিরহের শ্রেষ্ঠ পদটি। যেখানে তিনি লিখেছেন,
“এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওরএ ভরা বাদর মাহ ভাদরশূন্য মন্দির মোর।”
সখি আমার দুঃখের কোনো শেষ নেই। এ ভরা বাদল, ভাদ্র মাস। আমার মন্দির শূন্য। চারদিকে মেঘ গর্জন করছে, ভুবন ভরে বর্ষণ হচ্ছে, শত শত বজ্র পতিত হচ্ছে, ব্যাঙ এবং ডাহুক ডাকছে।
"এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটায়" যেমন লিখেছিলেন চণ্ডীদাস,
'এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা, কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে, দেখিয়া পরাণ ফাটে'
বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতা বর্ষার কাব্য; বর্ষাকে অবলম্বন করেই বাঙালির প্রেমের কবিতা।’ যাই হোক ফিরে যাই আবার বিংশ শতকের কবিদের কবিতার বর্ষায়।
পল্লীকবি জসীমউদদীনের প্রিয় ঋতু যে বর্ষাই হবে তা যেন সবারই জানা। কারণ পল্লীর সৌন্দর্য মানেই তো বর্ষা, আর তাই পল্লী কবি নিজের উপাধির সুবিচার করলেন যেন পল্লী- বর্ষা কবিতা লিখে,
"আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"
মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। 'বর্ষাকাল' কবিতায় মাইকেল যেমন লিখেছেন,
'গভীর গর্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদনদী ধরণী উপর।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।'
জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান হয়ে আল মাহমুদ। তিন জনের মধ্যে দুজনের প্রিয় ঋতুই ছিল যে বর্ষা। জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু হেমন্ত হলেও তিনি লিখেছেন ঋতু রাণী বর্ষা।
তাইতো "এ জল ভালো লাগে" কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন,
‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে
তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে;-নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে'
"বর্ষামঙ্গল নৃত্য মুখর বর্ষণ" কবিতায় আল মাহমুদ লিখেছিলেন,
"বৃষ্টির কণা ফণা ধরে আছে পথে
পথ কই বলো রথ থেমে আছে ঘাটে
এ খেলার মাঠে সূর্য নেমেছে পাটে।”
অন্যদিকে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মতো করে।’
কেবল রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন কবিদের ঋতু, তা সত্য। তবে কথাসাহিত্যিকেরাই বা বাদ যাবেন কেন? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকদের প্রিয় ঋতুও ছিল বর্ষা।
আর তাই "বিচ্ছেদ" কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রিয়জনকে দিলেন বর্ষার আবাহন।
'তোমাকে দিয়েছি আমার প্রাণের বর্ষা ঋতু
এখন আমার বুক জুড়ে রৌদ্র দহন
কখনো কি আর সাগরে মরুতে বাঁধবে সেতু
মেঘ- যবনিকা ছিঁড়ে ফেলে তুমি ছুঁয়ে যাবে মন?'
আহমাদ ইশতিয়াক
[email protected]
Comments