প্রাচ্যের অক্সফোর্ড: একটি অপ্রাসঙ্গিক অভিধা

দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আসলেই ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’?

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একবার বলেছিলেন, ‘এটা শুধুই কথার কথা।’ আরও কয়েকজন উনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছিলেন।

শিক্ষাবিদদের মতে, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ কথাটি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম দিকের সাফল্যকে মহিমান্বিত করার জন্যে ব্যবহার করা হতো।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত দ্য কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অবস্থান ৮০১-১০০০ এর মধ্যে এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।

দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পর্বত-সমান ফারাক এবং ঢাবির অভিধাটির কথা মাথায় রেখে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে অনেক তথ্য উন্মোচিত হয়।

করোনা মহামারি চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় দুটি কী করছে, প্রথমে সেটা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ গত বছরের ৯ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। তখন থেকে হলগুলো বন্ধ আছে।

এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধই আছে। মাঝে কিছু পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া বাকি সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের উদ্যোগে নির্মিত নীলক্ষেতের প্রবেশমুখে সুবিশাল একটি তোরণ রয়েছে। সেদিকে তাকালে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে লকডাউনে আছে, তা খুব সহজেই দর্শনার্থীরা বুঝতে পারেন।

যখন দেশে লকডাউন শুরু হলো, তখন ঢাবি কর্তৃপক্ষ যানবাহনের প্রবেশ আটকানোর জন্য এই তোরণে বাঁশের বেড়া দিয়ে দিলো।

কিছুদিন পর সরকার লকডাউন প্রত্যাহার করে নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় আর বেড়া সরায়নি। কয়েক মাস আগে যখন হল না খুলে পরীক্ষা নেওয়া হলো, তখন একবারের জন্য বেড়াগুলো সরেছিল। পরে আবারও যখন করোনাভাইরাসের দৈনিক শনাক্তের হার অনেক বেড়ে যায়, তখন বাঁশের বেড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনা হয়।

স্বভাবতই, কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে অস্থায়ী কাঁচাবাজার গজিয়ে উঠে এবং এতে বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই।

ফুলার রোডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বাসভবনের চারপাশেও ঢাবি কর্তৃপক্ষ বেড়া দেয়। অনেকে এটা দেখে ঠাট্টা করে বলছিলেন যে, বাঁশের বেড়া দিয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস ঠেকানোর চেষ্টা করছে।

বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ আরেকটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) সাধারণ মানুষের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম সমগ্র টিএসসি এলাকাজুড়ে টহল দিয়ে বেড়াত আর বারবার ‘বহিরাগতদের’ লাউড স্পিকারের মাধ্যমে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বলত। চায়ের স্টল ও অন্যান্য অস্থায়ী দোকানগুলোও অপসারণ করা হয়েছে।

এর এক পর্যায়ে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী করোনায় আক্রান্ত হন।

এ যাবৎ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া, বাঁশের বেড়া দেওয়া এবং চায়ের দোকান উচ্ছেদ কার্যক্রম।

ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাদের গবেষণাগারে গত বছরের ৫ মে থেকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা শুরু করেছিল। কিন্তু, অল্প কিছুদিন পরেই পরীক্ষা থেমে যায়। কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক ও গবেষণার কাজেই কেবল গবেষণাগার ব্যবহার হওয়া উচিত।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান গত বছরের ১ জুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ‘এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়; হাসপাতাল নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের তিনটি বিভাগ থেকে যেসব গবেষণাগারে ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোকে গবেষণার প্রয়োজনে ফিরিয়ে দিতে হবে। সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে তাদের আগের জায়গায় স্থাপন করতে হবে। এ কারণে করোনাভাইরাসের আর কোনো নমুনা পরীক্ষা করা হবে না।’

টেস্ট কিট ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামগুলো (পিপিই) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়ার কথা ছিল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ছিল পরীক্ষার অন্যান্য খরচ বহন করা। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, মাসে তাদের অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বাড়তি অর্থ জোগানো বেশ কঠিন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ তহবিলের অভাবকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে জনসাধারণের জন্য করোনাভাইরাস পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার পর ঘোষণা দিলো যে, তারা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নমুনা পরীক্ষা করবে এবং এর জন্য জনপ্রতি খরচ দিতে হবে দেড় হাজার টাকা।

শিক্ষকেরা এই সুবিধাটি নিলেও শিক্ষার্থীদের জন্য তা কঠিন হয়ে যায়।

এবার আমরা যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসি।

বাংলাদেশের প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রায় তিন মাস আগে গত বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়।

যেদিন বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই ১৭ মার্চ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্ট্যান্ট কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ বের করে।

একদিন পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, তারা দ্রুত গতিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন। দুই দিন পর তারা সহজে স্থাপনযোগ্য ভেন্টিলেটর তৈরি করার পরিকল্পনা ও সময়সীমা প্রকাশ করেন।

পরবর্তীতে বিভিন্ন পর্যায়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ নিয়ে একাধিক গবেষণা চালায়। এর মধ্যে রয়েছে কোন ধরনের মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তা চিহ্নিত করা, আইসোলেশনে থাকা শিশুদের মা-বাবারা কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন, কীভাবে লকডাউন চালু করা উচিত, কীভাবে ভাইরাসটি অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরকে আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্য, ইত্যাদি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ হয়, যেটি গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছে।

যখন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাগুলো চলছিল, তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ব্যস্ত ছিল তার রাস্তাগুলোতে বহিরাগতদের চলাফেরা সীমিত করার জন্যে চতুর্দিকে বেড়া দেওয়ার কাজে।

এই সময়ের মধ্যে (২০২০ সালের এপ্রিলে) ঢাবি নয়টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।

একটি ছিল উপাচার্যের কাছ থেকে আসা একটি শোকবার্তা, দুটি ছিল ছুটি বাড়ানো সংক্রান্ত এবং একটি ছিল জুম অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য।

আরও দুটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর করোনাভাইরাস তহবিলে অনুদান (এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা) দেওয়ার বিষয়ে। ফেস মাস্কের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য, টেলিমেডিসিন প্রকল্প ও ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সহায়তা সেবা দেওয়া নিয়ে ছিল আরও তিনটি বিজ্ঞপ্তি।

এখন আসুন আমরা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও নিজস্ব পরিমণ্ডলের ওপর তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার গবেষক রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করার ছয় মাসের মধ্যে চাকরি পেয়ে যান।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড প্রসঙ্গে আমরা উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের একটি মন্তব্যকে স্মরণ করতে পারি।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গর্বের বিষয় রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও ১০ টাকায় এক কাপ চা, সঙ্গে একটি সিঙ্গারা, একটি চপ ও একটি সমুচা পাওয়া যাবে না৷ কিন্তু, বাংলাদেশে এটি পাওয়া যায়৷ এটি যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে, তাহলে এটা গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পাবে।’

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড প্রায় ১০০ বছর আগে চালু হওয়ার পর থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছে এবং বর্তমানে তাদের মাঝের পর্বতপ্রমাণ দূরত্বটি আট হাজার কিলোমিটারের ভৌগলিক দূরত্বের চেয়েও অনেক বেশি।

একটি বিখ্যাত গানের সুরে বলা যায় ‘আজ দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে।’

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Jatiya Party central office vandalised, library set on fire in Kakrail

Protesters linked to Gono Odhikar Parishad demand ban on JP, accuse it of siding with Awami League

2h ago