পুলিশ কেন মামলা নিতে চায় না

(উপরের সারিতে বাম থেকে) মোহাম্মদ নুরুল হুদা, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, (নিচের সারিতে বাম থেকে) খুশি কবীর, কাজী রিয়াজুল হক ও নুর খান লিটন। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান, তার গাড়ি চালক ও দুজন সঙ্গী। পরিবারের দাবি, ১০ জুন দিবাগত রাতে রংপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে তারা নিখোঁজ হন।

তাদের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে দারুসসালাম ও মিরপুর থানায় মামলা করতে গেলে কোনো থানা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা গ্রহণ করেনি। শেষ পর্যন্ত রংপুর সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে পুলিশের দাবি, তিনি ঠিক কোন জায়গা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেই মামলা নেওয়া হয়নি। একই সময়ে চলচ্চিত্র অভিনয় শিল্পী পরীমনির ক্ষেত্রেও থানায় মামলা না নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

কেউ নিখোঁজ বা গুম হলে অথবা অন্য কোনো বিষয়ে থানায় গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আটক বা গ্রেপ্তারের দায় নিতে অস্বীকার, তাদের খুঁজে না পাওয়া ও মামলা করতে নিরুৎসাহিত করা এবং মামলা না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নুর খান লিটনের সঙ্গে।

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগের ক্ষেত্রে পুলিশ স্পেসিফিক কিছু তথ্য ছাড়া মামলা না নিলেও মিসিং ইনফরমেশন নিতে কোনো সমস্যা নেই।’

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে ১১ জনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছয় জনকে পরবর্তীকালে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং পাঁচ জনকে গুম করে রাখার কয়েক দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একসময় এটা করতো। আমি যখন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম তখন এগুলো নিয়ে কথা বলেছি। তখন দেখতাম, সরকার এই ধরনের অভিযোগ খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। তারা মনে করতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই তারা এগুলো করছে।’

বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাইরেও বিভিন্ন গ্রুপ এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে উল্লেখ করে ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রথমেই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করছে। তারা শুধু আটক বা গ্রেপ্তার করেনি বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারা এসব কাজ করছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা তাদের দায়িত্ব। এসব কারণে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা কমে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।’

মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মামলা না নেওয়ার ঘটনা শুধু যে নিখোঁজের ক্ষেত্রে ঘটে তা নয়, নারী নির্যাতন, অপহরণসহ অন্যান্য বিষয়েও থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। মামলা করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আমি জানি না, তারা কেন এটা করে। হতে পারে- তারা টাকা খেতে চায়, কাজ করতে চায় না অথবা দেখাতে চায় তাদের থানায় কোনো অপরাধ হয়নি।’

সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা শপথ নিয়ে তারা চাকরি শুরু করে। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে না কেন? মানুষ বিপদে পড়েই তাদের কাছে যায়। কাজ না করে টাকা নেওয়াটা এক ধরনের চুরি। আমার মনে হয়, এটা আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে এতো এতো পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, বিদেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তারপরও কেন কাজ হচ্ছে না। আমি জানি না তাদের কোন এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই।’

কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে, আবার অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগকারী প্রভাবশালী হলে তার মামলা নিতে বাধ্য হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরীমনির ঘটনায়ও প্রথম দিকে মামলা নিতে চায়নি, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিতে চায় না বলা হলে তারা জানায়, ব্যবস্থা নিলে তাদের শাস্তি পেতে হয়, চাকরিতে সমস্যা হয়, বদলি করা হয়। মনে রাখতে হবে পুলিশকে কোনো সরকারি দলের অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয় না। তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী। জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।’

গত বছরের আগস্ট মাসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুম হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনো ভাবে ফিরে এসেছেন।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার রয়েছে। কেউ যদি নিখোঁজ হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ বিষয়ে থানায় মামলা নেওয়া উচিত। তবে নিখোঁজের বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে না পারলে মামলা নেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা যেতে পারে। পরে জিডিটি মামলায় কনভার্ট হতে পারে।’

কেউ নিখোঁজ হলে তাকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব উল্লেখ করে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘পুলিশকে যে কাজের জন্য বসানো হয়েছে, তাকে সেই কাজ করতে হবে।’

বিবিসি বাংলার এক সংবাদে বলা হয়েছে, দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ স্বীকার করেছেন, তারা কোনো সাধারণ ডায়েরি বা মামলা গ্রহণ করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, উনি (ত্ব-হা) কোথা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সেই লোকেশনটা তারা নিশ্চিত না।

এ ছাড়া বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিকে অনুসন্ধানের জন্য পুলিশের আলাদা কোনো বিভাগ নেই।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গুম বিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ “ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনেস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স” গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার এখন পর্যন্ত এই কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেনি।’

আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) ২০২০ সালের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ছয় জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে চার জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন দুই জন।’

এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নুর খান লিটন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিগত দিনের এই ধরনের ঘটনা থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাউকে তুলে নিয়ে গেলে যে কয়েকটি লক্ষণ থাকে এ ক্ষেত্রেও (ত্ব-হা নিখোঁজ) সে রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে আছে, পুলিশ মামলা নিতে না চাওয়া। কোনো ক্রিমিনাল যদি তাকে তুলে নেয়, তাহলে পুলিশের দায়িত্ব তাদের খুঁজে বের করা। রাষ্ট্র তাদের লালন পালন করছে মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।’

তা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেলে যে ঘটনাগুলো ঘটে এ ক্ষেত্রেও তার অনেকগুলোর সঙ্গে মিল আছে উল্লেখ করে নূর খান বলেন, ‘যে সময় তিনি নিখোঁজ হয়েছেন, এ ক্ষেত্রেও একই সময়ে ঘটনাটি ঘটেছে। সকালের দিকে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন। এরপরে আছে মামলা না নেওয়া। নিখোঁজের পর পরিবার মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বর্তমানে ইসলামি বক্তাদের ওপর নজরদারি ও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে তাকে তুলে নিয়ে গেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে তারা যদি তুলে না নিয়ে থাকে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করা হোক। এই ঘটনার তদন্ত করে তাদের সঙ্গে কী ঘটেছে সেটা প্রকাশ্যে তুলে ধরা হোক।’

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago