ভিকটিম ব্লেমিং: সব দায় মেয়েটির!

বনানীর বাসায় সাংবাদিকদের কাছে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার বর্ণনা দেন পরীমনি। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ছবি: স্টার

কবি সুবোধ সরকারের আলোচিত ‘ধর্ষণ’ নামের কবিতার কয়েকটি পঙক্তি এ রকম, ‘কোন মেয়ের যদি সুন্দর দুটো পা থাকে, সে একশোবার/পা-খোলা পোশাক পরে রাস্তায় নামবে/ আমরা যারা ভালোবাসতে পারলাম না, তারাই/হেমন্তের সন্ধ্যায় হাত ধরার নাম করে বুক ধরতে চেয়েছি।’

কবিতার আরেক জায়গায় কবি বলছেন, ‘শুনুন, একটি মেয়ে কী পরবে, কী ভাবে হাসবে, কোথায় দাঁড়াবে/ সেটা তাকেই ঠিক করতে দিলে ভালো হয়/পুরুষ যন্ত্রটি আপনার, আপনি নিজেই ওটার দায়িত্ব নিন।’

কবিতার উল্লেখিত পঙক্তিগুলোর মর্ম বোঝা গেলেও সুবোধ সরকার ঠিক কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা রচনা করেছিলেন, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। কিন্তু, এটাও বাস্তবতা যে, ভারতের মতো বাংলাদেশেও ধর্ষণ কিংবা যৌন নিগ্রহের মতো অপরাধের জন্য অনেক সময় নিপীড়িত মেয়েটিকেই দোষারোপ করা হয়। এসব ঘটনার পেছনে নারী বা মেয়েটির ভূমিকা বা পরোক্ষ ইন্ধন থাকার মতো কিছু বিষয় খুঁজে বের করেন অনেকে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে নিগৃহীত নারীর পোশাক, আচরণ ও চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতাকে অভিহিত করে থাকেন ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ হিসেবে। তাদের মতে, এটা সেই ধরনের চর্চা যা সাধারণত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায়।

কলাবাগানে ‘ও’ লেভেলের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা এবং সর্বশেষ গত রোববার চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তাকে ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনার পর ভিকটিম ব্লেমিংয়ের এই প্রবণতাটি আবার সামনে এসেছে।

পরীমনির আলোচিত ওই পোস্টে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তিন লাখ ৩১ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, একই পোস্টে বিদ্রূপাত্মক ‘হাহা’ রিঅ্যাক্ট পড়েছে ৭১ হাজারের মতো। এ ছাড়া নেতিবাচক ও ‍কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যও এসেছে প্রচুর।

একজন নারী তাকে ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার মতো ভয়াবহ অভিযোগ তোলার পরেও তার প্রতি এমন অসংবেদনশীল আচরণ নিয়েও সামাজিক যোগোযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে।

এই পরিস্থিতিতে ভিকটিম ব্লেমিং ও অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে— এসব নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে।

এ বিষয়ে মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, ‘আমি ফেসবুকে দেখলাম সে অত রাতে ক্লাবে কেন গিয়েছে, এসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে।’

মির্জা তাসলিমার পর্যবেক্ষণ হলো, ‘আমরা বেশিরভাগ সময় কথা বলি সামাজিক জায়গা থেকে। মানুষ কী বলে, ভাবে সেটার জায়গা থেকে। কিন্তু, মানুষ তো আসলে মিডিয়ারও ভোক্তা। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়াও মানুষের মুখে ভাষা তুলে দেয়। যেভাবে প্রচার হয় সেখান থেকেও মানুষ অনেক সময় কথা বলে। আমার মনে হয়, সামাজিকভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক বিধি-নিষেধ তো প্রচলিত আছেই। কিন্তু, সেগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে উসকে দেওয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষের অংশগ্রহণ আছে। কিন্তু, সেটাকেও ম্যানুপুলেট করারও অনেক রাস্তা আছে।’

এই নৃবিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘সামাজিক বিচার, মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো এখনো আছে। এগুলো (কুরুচিপূর্ণ কথা) আগেও বলা হতো। কিন্তু, এগুলোকে যারা ক্যাপিটালাইজ করছে, এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করছে, তা ভিকটিম ব্লেমিংয়ের ক্ষেত্রে একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছে। একটা ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ সংঘবদ্ধভাবেও এটা করতে পারে। তাই কেবল সামাজিক লেন্স বা চোখ দিয়ে এটাকে বিচার করা যাবে না।’

অধ্যাপক তাসলিমার মতে, ‘এখনকার সমাজটা অনেক ভিন্ন। বিশেষ করে মহামারির ভেতরে অনেকের সময় কাটছে অনলাইনে। এক্ষেত্রে (ভিকটিম ব্লেমিং) তারও একটা বিরাট ভূমিকা আছে। মানুষের ইমোশনকে অ্যালগরিদমের মাধ্যমেও যে বদলে দেওয়া যায়, এই ব্যবস্থার মধ্যে যে নানা ধরনের মেকানিজম চালু আছে, সেখানেও অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে।’

এই অধ্যাপকের অভিমত, ‘এখন মানুষ যেভাবে রিঅ্যাক্ট করে, আমার মনে হয় আগের রিঅ্যাকশনগুলো এতটা ছিল না। এখন এগুলো অনেক বেশি পরিমাণ ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে। এমনকি মানুষের এসব চিন্তাভাবনা বিচারের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে।’

এক্ষেত্রে বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামি মিন্নির উদাহরণ টানেন মির্জা তাসলিমা। বলেন, ‘মিন্নির ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিল। অনেক ছবি, ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আমি এগুলো বিচারের মধ্যে রাখতে চাই।’

আইনের জায়গা থেকে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের কিছু প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘যে এভিডেন্স অ্যাক্টের মাধ্যমে আমাদের মামলার বিচার হয়, সেখানে একটা ধারায় বলা আছে, যদি কেউ প্রস্টিটিউট হয় তাহলে তার রেপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ প্রস্টিটিউট প্রমাণ করতে পারলে কারো বিরুদ্ধে রেপের অ্যালিগেশন টিকবে না।’

এই আইনজীবীর ভাষ্য, ‘এটা পরিবর্তনের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছি। আইন মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে পরামর্শ দিয়েছি। মতামত দিয়েছি। এখন যত সময় যাচ্ছে আমরা বলছি যে, অ্যা পারসন অব ব্যাড ক্যারেকটারও যদি হয়, সে যদি বলে নো, তাহলে নো মিনস নো। আবার এখন বিভিন্ন দেশ বৈবাহিক ধর্ষণকেও ধর্ষণ হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে। বাংলাদেশে যার কোনো পরিসর কিংবা পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।’

জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার পর্যবেক্ষণ, ‘একটা ক্যাপিটালিস্ট দেশ যখন এগোতে থাকে, তার সঙ্গে আরও অনেক বিষয় আসতে থাকে। যে রিলিজিয়াস বা মোরাল জায়গা থেকে আমরা অনেককিছু বোঝার চেষ্টা করতাম, সেগুলো তো ভাঙছে। একটা পক্ষ খুব স্ট্রংলি মর্ডার্ন ওয়ে অব লিভিংটাকে সাপোর্ট করছেন, আরেকটা পক্ষ পুরোনো পশ্চাৎপদ জায়গাতেও থেকে যাচ্ছেন। এটাও একটা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করছে।’

সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা মিডিয়াবাহিত যে জনমত সমাজে তৈরি হচ্ছে, তার প্রভাব বিচার ব্যবস্থাতেও পড়ছে মন্তব্য করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘কে কীভাবে ভাবছে, পাবলিক অপিনিয়ন কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তার এক ধরনের প্রতিফলন সমাজে থাকে। কিন্তু, কে ভালো, কে মন্দ সেটা বোঝার আগে আইন তার নিজের অবজেকটিভ ক্যারেক্টার কেমন ধারণ করবে সেটা বোঝা উচিত। সেটা আসলে আমরা দাঁড় করাতে পারছি না। পাবলিক অপিনিয়ন বিচার ব্যবস্থায় কোনো ভূমিকা রাখার কথা না। কিন্তু, আমাদের দেশে আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি, এটা বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।’

ফেসবুকে পরীমনির দেওয়া পোস্টের নিচে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং বিদ্রূপাত্মক রিঅ্যাক্ট প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘এটা তো বহুবছর ধরেই হয়ে আসছে। একজন নারীর সঙ্গে যে ধরনের ঘটনাই ঘটুক না কেন, তার চরিত্র, পোশাক ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সবার মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়।’

ফরিদা ইয়াসমিনের বক্তব্য, ‘নারীদের এখনো সমাজে অধস্তন হিসেবে ভাবা হয়। পরীমনি একজন নায়িকা। শ্যুটিংয়ের জন্য তাকে নানা সময় নানা জনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এটা নিয়ে তো কথা বলার কিছু নেই।’

আরও পড়ুন:

দায় মেয়েটিরই!

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

13h ago