স্কুল থেকে করোনা সংক্রমণ হয় সামান্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন

স্টার ফাইল ছবি

করোনা মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবার ক্ষতির পরিধি ও ব্যাপকতা এক নয়। করোনা মোকাবিলার পথ, পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গিও সবার একই রকম ছিল না। সম্প্রতি ইউনেস্কো করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি) মাঝারি (ভারত, ইরান) ও সর্বনিম্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশ (বাংলাদেশ, পাকিস্তান)। এ সব দেশে প্রতি ১০ লাখে মৃতের সংখ্যা— আমেরিকা (১০ শতাংশ-১৮০০ জন), ইংল্যান্ড (৬.৫ শতাংশ-১৯০০ জন), ইতালি (৭ শতাংশ-২১০০ জন) ভারত (২ শতাংশ-২২০ জন), পাকিস্তান (০.৫ শতাংশ-৯০ জন), বাংলাদেশ (০.৫ শতাংশ-৭৫ জন)।

ইউনেস্কোর সেই গবেষণায় দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এই করোনায় খোলা ও বন্ধ দুইই ছিল। আর কিছু দেশে একেবারেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। বিশ্বে এমন দেশের সংখ্যা ১৬টি। এই দেশগুলো হলো— উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, সৌদি আরব, ভেনিজুয়েলা, মাদাগাস্কার, লাওস, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, সুরিনাম, সুদান, তুরস্ক, ইরাক, পেরু, উরুগুয়ে, মেক্সিকো। এই ১৬টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ—যেখানে আজ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা এই দেশগুলোতে মূলত রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, গণবিরোধী ও এককেন্দ্রীক শাসকরা ক্ষমতায় আছেন।

করোনায় সবচেয়ে কম ক্ষতির তালিকায় থাকা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণ কী? নীতিনির্ধারকরা কী বলছেন? তাদের বক্তব্য, স্কুল খুলে দেওয়া হলে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। করোনা সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাবে, শিক্ষার্থীরা মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। সে কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর টানা বন্ধ আছে। ভারত-পাকিস্তানেও বিরতি দিয়ে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছিল, আবারও খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে কি আসলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাবে? এ বিষয়ে গত বছর আমেরিকার ফ্লোরিডায় একটি চমকপ্রদ গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে জানা যায়, মার্চে জরুরি অবস্থা জারির পর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসে স্কুল পুনরায় খোলা হয়। সে সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যায়। দেখা যায়, স্কুল খোলা থাকার সময়টায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনা আক্রান্ত হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় সংক্রমিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ স্কুলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে, বাকি ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছে কমিউনিটি ও সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে। আর উচ্চমাধ্যমিকের বা ১২ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মাত্র ১১ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, বাকিটা এসেছে সামাজিক মেলামেশা থেকে। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। সে অবস্থায় সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে- বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে বাধা কোথায়? ফ্লোরিডার গবেষণা বলছে, স্কুল খোলার কারণে যেসব শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে তার খুব সামান্য দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।  

বাংলাদেশের বাস্তবতা আরেকদিক থেকে ভিন্ন। এখানে লকডাউন আছে কিন্তু তা কাজ করছে না। অফিস-ব্যাংক, গণপরিবহন, হাট-বাজার-বিপণি-গার্মেন্টস সবকিছু খোলা আছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এটা স্ববিরোধিতা ও তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখা হলো কিন্তু তাদের অভিভাবকরা ঘরে নেই, শিক্ষার্থীরা নিজেরাও ঘরে নেই, সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার ছেলেমেয়ে পরিবারের সঙ্গে একত্র হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে অসুবিধা কোথায়?

বাংলাদেশেও করোনার অবস্থাও সকল জেলা-উপজেলায় একরকম নয়। গ্রাম এলাকায় করোনার ন্যূনতম প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে সমান বা গড় সিদ্ধান্ত দিয়ে ধারাবাহিক বন্ধ রাখা কতটা যৌক্তিক? শহরাঞ্চলে কিছু অনলাইন স্কুল-ক্লাস হলেও গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট, প্রযুক্তি, ডেটা, ডিভাইস ছাত্র-শিক্ষকদের দক্ষতার সংকট-সীমাবদ্ধতার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। ডিজাটালাইজশনের কথা বলা হলেও তা আসলে এক ধরনের প্রতারণা। আর্থিক-আঞ্চলিক দিক থেকে শিক্ষায় নানামাত্রিক বৈষম্য তো আছেই। এসব নিয়ে কি তাদের কোনো বক্তব্য আছে?

তারচেয়ে বড় বিষয় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় কিনা? অভিভাবকরা চান কিনা তাদের সন্তান-পোষ্যরা স্কুলে যাক, সেটা নিয়ে কি কোনো জরিপ-গবেষণা হয়েছে? বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলা রাখার বিষয়ে কিছু বলেছেন? তাহলে কিসের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেড় বছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে? বিশ্বের প্রভাবশালী জনস্বাস্থ্যবিদরা শিশুর বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ অনেক বিষয় এক্ষেত্রে তাদের জন্য রক্ষাকবচ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিভিন্ন পদ্ধতি নেওয়া যেত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যে যার মত করে সে পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জীবনকে, তাদের মানসিক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের সব কিছুতেই কেন্দ্রীকতা একটা বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি করেছে। দেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না। তারা ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর এরাও তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর দিকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ীরা, দোকানীরা, গণপরিবহন তাদের ব্যবসা চালিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধ ও ব্যাপক তৎপর হলেও দেশে বহু শিক্ষক সংগঠন থাকলেও এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য ও ভূমিকা দেখা যায় না। তাদের সংগঠনগুলো কি শুধু বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার জন্য? শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কি তাদের কোনো দায় নেই?

করোনায় সুইডেনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি এবং সেখানে লকডাউনও দেওয়া হয়নি। ভরা দুর্যোগেও সেখানে বার-রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল। তার পরেও তারা মহামারি মোকাবিলা করে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরেছে। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, তাকে স্থগিত করার, বন্ধ করার অধিকার সরকারের নেই। যদি সবকিছুর ধ্বংসাবস্থা, অচলাবস্থা তৈরি হতো তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। এটাই হচ্ছে সে দেশের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার মানদণ্ড এবং তা সংরক্ষণে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, যেমনটা করোনায় করছে। কানাডাও প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে অফলাইন-অনলাইন স্কুল নিয়মিত রেখেছে।

লেখা অনেক লম্বা করা যাবে, কিন্তু তার খুব দরকার নেই, কারণ এগুলো নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। সে আলাপের সামান্য অনুসরণ করলেই কাজ হবে। শেষে শুধু এটুকু বলছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে দ্রুত খুলে দেওয়া যায় তার একটা পরিকল্পনা প্রকাশ করুন। করোনায় শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় তার নকশা দিন। চলমান বিপদ-দুর্যোগ সহসাই শেষ হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা সে ইংগিতই করছেন। অতএব করোনায় কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কতটা কম ক্ষতির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায় সে জন্য তৎপর হোন। তার জন্য অনেক অর্থের দরকার নেই। জগতে দুর্যোগ-মহামারি নানা রোগ-বালাই আসবে। তার উপযুক্ত কাঠামো, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না।

করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ব্রিটেন প্রথম ঢেউয়ের শুরুতেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। তারা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল এ দুর্যোগ সহজেই যাবে না। কেবল আমাদের নীতি নির্ধারকরাই বুঝতে পারেননি এবং অন্যদের দেশ থেকে কিছু শেখেনওনি। আমাদের দেশেকেও নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। তার ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের দক্ষতার সুনামও আছে। এক্ষেত্রেও তার ছাপ রাখতে হবে। 

ড. মঞ্জুরে খোদা: শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক, অ্যাক্টিভিস্ট, সাবেক ছাত্রনেতা।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

Last push to beat US tariff deadline

As US President Donald Trump prepares to roll out sweeping new tariffs on countries without bilateral trade deals, Bangladesh has entered final negotiations in Washington, DC, scrambling to shield its economy from the threat of a 35 percent duty on its exports.

7h ago