সামাজিক সুরক্ষার বাজেটে প্রকৃত দরিদ্রদের ভাগ সামান্যই

সার্কাসে দড়াবাজিকররা যখন উঁচু দড়ি দিয়ে হাঁটেন তখন তাদের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ার আশঙ্কা থেকেই দড়ির নিচে একটি নিরাপত্তা জাল রাখা হয়।
ঢাকার তেজগাঁওয়ে বয়স্ক ভাতা নিতে এসে দীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকেন এক দল অসহায় প্রবীণ। ছবি: এস কে এনামুল হক

সার্কাসে দড়াবাজিকররা যখন উঁচু দড়ি দিয়ে হাঁটেন তখন তাদের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ার আশঙ্কা থেকেই দড়ির নিচে একটি নিরাপত্তা জাল রাখা হয়।

সেভাবেই রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী নাগরিকদের চরম আর্থিক দুর্দশা থেকে সুরক্ষিত রাখে।

তবে কেউ যদি বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর বাজেটের দিতে তাকায় তবে দেখবে যে, এর একটা বড় অংশ এই উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়নি। বরং যারা দরিদ্র নন তাদের জন্যই এটি করা হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝা যাক। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে জন্য বরাদ্দের এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকার ২৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ সাড়ে সাত লাখ সরকারি কর্মচারীর পেনশন এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে ব্যয় হবে। যারা কেউ দৈন্যদশার মধ্যে নেই।

এছাড়া জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের জন্য এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ হিসেবে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর বাজেটের নয় শতাংশ ধরা হয়েছে। শিক্ষা উপবৃত্তি এবং কৃষির ভর্তুকির টাকা এখান থেকে নেওয়া হলে হত দরিদ্রদের অংশ আরও ছোট হবে।

কাগজেকলমে, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদের মতো ব্যয় বাদ দিলে প্রকৃত দরিদ্রদের জন্য থাকে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ।

‘দ্য স্টেট অব সোশ্যাল সিকিউরিটি নেট’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের সমীক্ষায় দেখা যায়, এটি জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ ছিল। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, এই ব্যয় দেশে চূড়ান্ত দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী (দিনে ১.৯০ ডলারেরও কম আয়) মানুষের সংখ্যা ৩৬ শতাংশ কমি এনেছিল।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যয় শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং ভুটানের চেয়ে বেশি তবে দক্ষিণ এশিয়ার গড় শুন্য দশমিক ৯ শতাংশের চেয়ে কম। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপির গড়ে দেড় শতাংশের তুলনায়ও কম।

সংক্ষেপে, যদিও আসন্ন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত সামাজিক সুরক্ষা বাজেট চলতি অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেড়েছে তবে বাংলাদেশের দরিদ্র এবং মহামারির কারণে সৃষ্ট নতুন দরিদ্ররা আনুপাতিকভাবে এটি থেকে উপকৃত হবে না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, যদিও সরকার সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়িয়েছে, তবুও এটি অপ্রতুল।’

এমনকি, মহামারি শুরুর আগেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ কম ছিল।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় পেনশন এবং সঞ্চয়পত্রের সুদকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। কারণ এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে এই খাতে হিসাব করা হয় না। এমনকি বিশ্ব ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও এগুলোকে সুরক্ষা বেষ্টনীর প্রকল্প থেকে বাদ দেয়।’

মহামারিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে নতুন করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার প্রস্তাব করেছিল। তবে, হিসাব মতে উপকারভোগী প্রতি বরাদ্দের পরিমাণের পরিমাণ বাড়েনি।

বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৫৭ লাখ ছাড়িয়েছে। তারা প্রত্যেকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে পাবেন। বাংলাদেশে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে চালু হওয়া এই ভাতা বিশ্বের অন্যান্য দেশে গুলোর তুলনায় খুবই অল্প।

২০২১-২২ অর্থবছরে বিধবা ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরও চার লাখ ৭৫ হাজার বেড়েছে। তারাও প্রত্যেকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা পাবেন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে চালু হওয়া এই ভাতা শুরুতে ১০০ টাকা ছিল এবং তিন বছর আগে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

ভারতে বয়স্কভাতা হিসেবে ৬০-৭৯ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তারা ৭২০ টাকা এবং ৮০ বছরের ওপরে যাদের বয়স তারা প্রতি মাসে এক হাজার ২০০ টাকা পান। দিল্লিতে প্রতি মাসে বিধবা ভাতা হিসেবে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ন্যূনতম জীবন মান বজায় রাখতে একজন মানুষের প্রতি মাসে এক হাজার ৮৬২ টাকা প্রয়োজন হতো।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন যে, মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির বিবেচনায় এই পরিমাণ অর্থ একেবারেই নগণ্য।

সেলিম রায়হান বলেন, ‘যদিও প্রধানমন্ত্রী ভাতা বাড়িয়েছেন, তবে মুদ্রাস্ফীতির কারণে তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। বছরের পর বছর ধরে এটি অপরিবর্তিত রয়েছে।’

 

(মূল প্রতিবেদন থেকে সংক্ষেপিত)

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুমন আলী

Comments

The Daily Star  | English

Don’t stop till the dream comes true

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday urged key organisers of the student-led mass uprising to continue their efforts to make students’ and the people’s dream of a new Bangladesh come true.

2h ago