সিনোফার্মের টিকাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না সৌদি প্রবাসীদের
সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এই টিকা সৌদি আরবের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। ফলে টিকা নিলেও সৌদিগামী শ্রমিকরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলো দূর হবে না বলে মত দিয়েছেন রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কর্মকর্তারা।
গত মাস থেকে কার্যকর হওয়া সৌদি জেনারেল অথরিটি অব সিভিল এভিয়েশনের ভ্রমণ নির্দেশিকা অনুসারে, সৌদি আরবে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি যাত্রীদের ফাইজার-বায়োনটেক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না বা জনসন অ্যান্ড জনসন— এগুলোর মধ্যে থেকে কোনো একটির সম্পূর্ণ ডোজ টিকা নিতে হবে।
তা না হলে, যাত্রীদের ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। শ্রমিকরা বলছেন, মহামারির মধ্যে এই পরিমাণ টাকা জোগাড় করা তাদের ওপর একটি বাড়তি অর্থনৈতিক বোঝা।
এ বিষয়ে সমাধানে আসতে গতকাল শুক্রবার সরকারকে অবিলম্বে সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন জনশক্তি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কর্মকর্তারা। এজেন্সিগুলো সৌদি নিয়োগদাতাদের পক্ষে শ্রমিক নিয়োগ দেয়।
দেশে ফাইজারের যেসব টিকা আছে, সেগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করার প্রস্তাব দিয়েছেন এসব এজেন্সির কর্মকর্তারা। এ ছাড়া, শ্রমিকদের জন্য জনসনের টিকা আমদানিরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কারণ এই টিকা একটি ডোজ নিতে হয়। ফলে এজেন্সি ও প্রবাসী শ্রমিক দুপক্ষেরই সময় বাঁচবে বলে মনে করছেন তারা।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ যে চারটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যে সিনোফার্ম নেই তা জানিয়ে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন তারা। উপযুক্ত টিকা পাওয়া মাত্রই তা সৌদিগামী শ্রমিকদের দেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার প্রবাসী শ্রমিকদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়, সরকারের সিনোফার্ম টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আজ শনিবার থেকে বিদেশগামী বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকরা টিকা পাবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে এই টিকাদান কর্মসূচির ‘টার্গেটেড জনসংখ্যার’ যে তালিকা দেওয়া আছে, তাতে ‘অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত’ প্রবাসী শ্রমিকদের তৃতীয় স্থানে রাখা হয়েছে। যে প্রবাসী শ্রমিকরা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনে নিবন্ধিত বা অনুমোদিত, তারাই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং ২৫০ শয্যার হাসপাতালের নির্ধারিত টিকাকেন্দ্রে এ কর্মসূচি চলবে।
দেশের বাইরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার সৌদি আরব। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্ল্যাটফর্ম সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদের তথ্য অনুসারে, নতুন নিয়োগ ভিসা নিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পরিষদের সদস্য এবং রিক্রুটিং এজেন্সিস ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ফখরুল ইসলাম গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সৌদি আরবের অগ্রাধিকার তালিকায় সিনোফার্মের টিকা না থাকায়, প্রবাসী শ্রমিকদের এ টিকা দেওয়ার মাধ্যমে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সৌদি আরব সিনোফার্মের টিকা নেওয়া শ্রমিকদের অনুমোদন দেবে কি না সে বিষয়ে দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া উচিত সরকারের।’
‘সরকার সৌদিগামী শ্রমিকদের জন্য ফাইজারের টিকা বরাদ্দ দিতে পারে বা সৌদি সরকারের সঙ্গে চীনের টিকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। অথবা প্রবাসী কল্যাণ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে শ্রমিকদের জন্য জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা আমদানি করতে পারে’— বলেন ফখরুল।
এ ছাড়া, বাংলাদেশে টিকা পাওয়ার জন্য বয়স ৪০ বছর বা তার বেশি হতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ প্রবাসী শ্রমিকের বয়সই ৪০ এর কম। এ বিষয়টিও একটি সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরীর মতে, প্রবাসী শ্রমিকদের টিকাদানের ব্যাপারে সরকারের আরও তৎপর হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘টিকা গ্রহণ না করা একজন শ্রমিককে সৌদি আরবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকতে এক হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হবে। সরকার প্রত্যেক শ্রমিককে কোয়ারেন্টিন খরচ বাবদ ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপরও, শ্রমিকদের বাড়তি অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতেই হবে।’
রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম টিপু সুলতান বলেন, ‘মহামারির মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শুধুমাত্র সৌদির শ্রম বাজারই খোলা আছে। সরকার কোয়ারেন্টিন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও, এখনো কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে টিকাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
সৌদি এয়ারলাইন্সের এক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, যে শ্রমিকরা চারটি নির্দিষ্ট কোম্পানির টিকা নেবে, শুধু তাদেরই সাত দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
‘সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কোম্পানির টিকা নেওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাত দিনের কোয়ারেন্টিন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই’, যোগ করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে বিএমইটির মহাসচিব শহিদুল আলম ডেইলি স্টারকে জানান, শুধু টিকাই নয়, অন্যান্য সেবার বিষয়েও প্রবাসী শ্রমিকদের সহায়তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম।
Comments