এসএমই খাতের জন্য বাজেটে কিছুই নেই
করোনা মহামারিতে দেশব্যাপী লকডাউন আরোপের পর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে, আংশিকভাবে লকডাউনের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার পর কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব।
ঋণের জন্য মরিয়া হয়ে থাকা সিএমএসএমইদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় তহবিল দিতে অনিচ্ছুক ব্যাংকগুলোর জন্য একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হয়। কিন্তু, ব্যাংকের কঠিন শর্তের কারণে এই উদ্যোগটি আকর্ষণ হারায়।
১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটও এ ক্ষেত্রে হতাশা বাড়িয়েছে। কারণ অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত এই খাতের উন্নয়নে সেখানে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি।
সরকার সিএমএসএমইদের সহায়তা করতে ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছিল। কিন্তু, ব্যাংকগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তহবিল পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় এবং তারা এ বিষয়টির প্রতি খুব একটা নজর না দেওয়ায় অতি সাম্প্রতিককাল বাদ দিলে এই প্যাকেজের আওতায় খুব বেশি পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়নি।
তবে, শুধু প্রণোদনা প্যাকেজটিই সিএমএসএমইদের অসন্তোষের কারণ নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খাতের উন্নয়নের জন্য পরোক্ষ উদ্যোগ হিসেবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর কমানোর প্রস্তাবটি সিএমএসএমইদের ব্যবসার পুনর্জাগরণ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
প্রস্তাবিত বাজেট থেকে কৃষি খাত, তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত শিল্প, নারী উদ্যোক্তা এবং বড় শিল্পের জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে কাজ করছে এমন কিছু সিএমএসএমই কিছুটা উপকৃত হতে পারে। তবে, গ্রামীণ সিএমএসএমই- যারা প্রায় দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীদেরকে নিয়োগ দেয়, তারা এসব প্রস্তাবিত উদ্যোগ থেকে কোনো সুবিধা পাবে না।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং ট্রেড বডির নেতারা এ খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ সহায়তার দাবি জানান।
সিএমএসএমই ব্যবসার পরিচালকরা বলেছেন, প্রায় ১৫ শতাংশ সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বন্ধ আছে ও ৫০ শতাংশ আর্থিক সহায়তার অভাবে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।
মহামারির কারণে সর্বাধিক পরিমাণ মানুষ সিএমএসএমই খাত থেকে চাকরি হারিয়েছেন এবং তাদেরকে চাকরির বাজারে ফিরিয়ে আনাটা সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘যেহেতু তাদের হাতে কোনো টাকা নেই এবং তাদের যারা ধার দিতেন- তাদের হাতেও টাকা নেই, তাই সিএমএসএমইদের এখন প্রয়োজন নগদ অর্থ সহায়তা।’
তিনি সিএমএসএমইদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি দ্বিতীয় প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর প্রস্তাব দেন, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়ে।
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এই তহবিলের মোট পরিমাণের ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের কাছে যাওয়া উচিৎ।’
তিনি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ক্ষুদ্র-অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোকেও (এমএফআই) ঋণ বিতরণের কাজে সংযুক্ত করার সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি সিএমএসএমই আছে, যারা বেসরকারি খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান করে থাকে এবং মহামারি আঘাত হানার আগে এই খাত থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৫ শতাংশ আসতো।
মে পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলের মাত্র ৭২ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বড় শিল্প খাতের জন্য বরাদ্দ করা প্রণোদনা প্যাকেজের ১০০ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে।
সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের দেওয়া শর্তগুলো পালন করতে পারেন না দেখে তারা (ব্যাংক) সিএমএসএমইদের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখায়। তাদের (সিএমএসএমই) একটি অংশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই এবং তারা এনজিও ও এমএফআই থেকে ঋণ নিয়ে অভ্যস্ত।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন গত শনিবার সিপিডি’র একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে পারিনি।’
কুটির ও অতিক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি সরকারকে অনুরোধ করেন।
তিনি জানান, ব্যাংক ছাড়াও ট্রেড বডি ও চেম্বারগুলোকে ঋণ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ তারা স্থানীয় ট্রেড এসোসিয়েশনের সঙ্গে নিবন্ধিত।
যেহেতু বেশিরভাগ সিএমএসএমই এখনো অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই তিনি ঋণ পরিশোধের সময়সীমাকে ৩০ জুন থেকে বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান বলেন, ‘বাজেটে বর্ণিত উদ্যোগগুলো সিএমএসএমই খাতকে সুরক্ষিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।’
তিনি আরেকটি বড় আকারের তহবিল চালুর পরিবর্তে আগের প্যাকেজ থেকে সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত ও এ সংক্রান্ত নীতিমালাকে সহজ করার সুপারিশ করেন। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমইগুলো সেখান থেকে ঋণ নিতে পারে।
বিক্রির ক্ষেত্রে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আগামী দুই বছর সিএমএসএমইদের ওপর প্রযোজ্য পাঁচ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা বা তার চেয়ে কম, তাদেরকে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে, অনেক বড় ও সমন্বিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গ সংগঠনগুলো সিএমএসএমইদের জন্য নির্ধারিত সুবিধাগুলো উপভোগ করে থাকে।
‘প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সুবিধাগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ পরিমাণটি ১০ কোটি টাকা হওয়া উচিৎ’, বলেন জামান।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকারের উচিৎ ছিল প্রস্তাবিত বাজেটে সিএমএসএমইদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল বরাদ্দ করা।’
‘নতুন তহবিলটিতে ২০ হাজার কোটি থেকে ৩০ হাজার কোটির মধ্যে যে কোনো পরিমাণ টাকা থাকতে পারে। এই তহবিলের অর্ধেক অনুদান হিসেবে দেওয়া উচিৎ’, বলেন তিনি।
মনসুর ঋণের ক্ষেত্রে চার শতাংশ ভর্তুকি অব্যাহত রাখা এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোরও আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা মনসুরের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিএমএসএমইদের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগটি এ পর্যন্ত কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি।
তিনি মনে করেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ঋণ দিতে উৎসাহী হয়, সেজন্য আরও কার্যকর সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
মনসুর বলেন, ‘সব ঝুঁকি ব্যাংকের ওপর চাপানো উচিৎ নয়।’
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তহবিলের প্রবাহের জন্য শুধুমাত্র ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীলতা। বেশিরভাগ ব্যাংক এসএমই খাতে খুব একটা নজর দিচ্ছে না এবং তাদের কাছে পৌঁছানোর মতো উপযুক্ত অবকাঠামোও ব্যাংকগুলোর নেই।
কিছু ব্যাংক ট্রেড ফাইনান্সিং ও কিছু ব্যাংক কর্পোরেট ব্যাংকিংয়ের ওপর নজর দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, এ খাতের ঋণদাতাদের প্রণোদনা প্যাকেজের ভাগটি বিতরণ করতে মূলত এনজিও ও এমএফআইদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
কিন্তু, ব্যাংকের চেয়ে এমএফআইদের পরিচালনা খরচ বেশি এবং তারা (এমএফআই) ঋণগ্রহীতাদের নয় শতাংশ হারে ঋণ দিতে পারে না।
মনসুর আগে বলেছিলেন, এ কারণে যেসব ব্যাংক সিএমএসএমই খাতে নজর দিচ্ছে, তাদেরকে একটি কার্যকর ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের প্রচলনের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের জন্য অধিক পরিমাণে তহবিল দেওয়া উচিৎ ছিল।
‘সুদের ক্ষেত্রে আরও ভর্তুকি, একটি কার্যকর ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, ব্যাংক, এনজিও ও এমএফআইদের মাঝে চুক্তি স্বাক্ষর এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সিএমএসএমইদের কাছে তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ তহবিলগুলো পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে’, বলেন তিনি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments