অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে জীবন বাঁচায় প্রায় শতভাগ

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। দেশের পশ্চিমাংশের বর্ডার ঘেঁষা জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার এখন ৩০-৬৫ শতাংশ। জিনোম সিকোয়েন্স ডাটা অনুযায়ী এই সংক্রমণের ৮৫ ভাগই হচ্ছে ভারতের অতিসংক্রামক ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ দিয়ে। এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন সীমান্ত অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়িছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে। গোটা দেশে এখন করোনা সংক্রমণের হার ১৫-১৮ শতাংশ এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে প্রতিদিন। এটা এখন নিশ্চিত যে দেশে মহামারির তৃতীয় ঢেউটি হতে যাচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে।
ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। দেশের পশ্চিমাংশের বর্ডার ঘেঁষা জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার এখন ৩০-৬৫ শতাংশ। জিনোম সিকোয়েন্স ডাটা অনুযায়ী এই সংক্রমণের ৮৫ ভাগই হচ্ছে ভারতের অতিসংক্রামক ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ দিয়ে। এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন সীমান্ত অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়িছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে। গোটা দেশে এখন করোনা সংক্রমণের হার ১৫-১৮ শতাংশ এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে প্রতিদিন। এটা এখন নিশ্চিত যে দেশে মহামারির তৃতীয় ঢেউটি হতে যাচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোভিড ভ্যাকসিনগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কতটুকু কার্যকর? দেশে যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) নিয়েছেন, তারা কি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত?

এই প্রশ্নটি এখন যুক্তরাজ্যেও সবচেয়ে বড় একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যও এখন তৃতীয় ঢেউয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সংক্রমণের ৯০ শতাংশই হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। দেশের ৬২ শতাংশ মানুষকে কোভিড ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ দেওয়া হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি হচ্ছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করেই আগামী ১৭ জুলাই লকডাউন সম্পূর্ণরূপে শিথিল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকারের সামনে এখন একটিই প্রশ্ন, ভ্যাকসিন কি পারবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে মৃত্যু ঠেকাতে?

পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড অতিসম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে এপ্রিল থেকে জুনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ১৪ হাজার রোগীর ওপর। এই গবেষণার একটি প্রি-প্রিন্ট তারা তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ১৪ জুন। ফলাফলে দেখা যায় যারা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নিয়েছেন, তাদের ভেতরে ৯২ শতাংশ কোনো ধরনের মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়নি বা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। আর যারা ভ্যাকসিনটির একটি ডোজ নিয়েছেন, তাদের ৭১ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

একই ধরনের ফলাফল দেখা গেছে ফাইজারের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও। যারা ফাইজারের দুটো ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর যারা অন্তত একটি ডোজ নিয়েছিলেন, তাদের ৯৪ শতাংশ মারাত্মক কোভিড থেকে মুক্ত ছিলেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ১৪ হাজার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের মধ্যে যে ১৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের কেউই মৃত্যুবরণ করেননি। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৫ জুনের প্রেস রিলিজের দাবি অনুযায়ী, তাদের ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে মৃত্যু ঠেকায় শতভাগ। উপরের সংখ্যা থেকে হয়তো তা দাবি করা যেতেই পারে। তবে, পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ভ্যাষ্যমতে, ভবিষ্যতে এই মৃত্যু প্রতিরোধে ‘শতভাগ’ সংখ্যাটির সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে।

তবে এই ‘রিয়েল লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা নিশ্চিত যে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজার ভ্যাকসিনের দুইটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হওয়া মারাত্মক কোভিড থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয় গড়ে ৯৪ শতাংশ। আর যারা যেকোনো একটি ভ্যাকসিনের একটি ডোজ নিয়েছেন, তারা মারাত্মক কোভিড থেকে রক্ষা পাবেন ৭৫ শতাংশ।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বেশ উল্লেখযোগ্য। তা হলো, ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নেওয়ার পরও এই ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রায় ২০-৪০ শতাংশ। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের ২৪ মে প্রকাশিত মেড-আর্কাইভের একটি প্রি-প্রিন্টের ফলাফল থেকে দেখা যায়, অক্সফোর্ড বা ফাইজার ভ্যাকসিনের একটি ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সিম্পটমেটিক কোভিড প্রতিরোধ করে মাত্র ৩৩ শতাংশ। তবে, অক্সফোর্ড এবং ফাইজারের দুই ডোজ টিকা এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয় যথাক্রমে ৬০ ও ৮১ শতাংশ।

অর্থাৎ, পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের চালানো দুটো পৃথক ‘রিয়েল-লাইফ এভিডেন্স’ থেকে এটা পরিষ্কার যে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হলেও তা থেকে মারাত্মক কোভিড বা মৃত্যু কমে যায় প্রায় শূন্যের কোঠায়। আর যারা ভ্যাকসিনের একটি ডোজ পেয়েছেন, তারা মারাত্মক কোভিড থেকে ৭৫ শতাংশ মুক্ত থাকতে পারেন।

সুতরাং বাংলাদেশ যারা ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও এই তৃতীয় ঢেউয়ের সময় আক্রান্ত হচ্ছেন বা হবেন, তাদের ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই। কেননা, তাদের ১০০ জনের মধ্যে ৯৪ জনই সামান্য ভুগে কোভিড থেকে সেরে উঠবেন।

এ কারণেই কোভিড মহামারিতে জীবন রক্ষায় ভ্যাকসিনের ভূমিকা অপরিহার্য। এটা আর এখন কোনো তত্ত্বগত বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা নয়। এটা এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা প্রমাণিত হয়েছে অক্সফোর্ড ও ফাইজার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে। তবে, একই ফল হয়তো দেখা যাবে চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও। কারণ, সব ভ্যাকসিনের মূলনীতি একই, দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে প্রশিক্ষিত করা। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যতগুলো ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সবগুলোই কার্যকর ভ্যাকসিন।

তবে, দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে গণটিকা কার্যক্রমের সূচনা ভালো হলেও এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যেখানে এই সংখ্যাটি ভারতের ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ এবং নেপালের ক্ষেত্রে নয় শতাংশ। এই সংখ্যাটি যত দিন পর্যন্ত ৬০-৭০ শতাংশে না উন্নীত করা যাবে, ততদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের সুফল পাওয়া যাবে না। মহামারি থেকে বের হয়ে আসার এখন একটিই রাস্তা। আর তা হলো দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোভিড ভ্যাকসিনের আওতায় আনা।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

আরও পড়ুন:

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষায় এক ডোজ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন যথেষ্ট নয়

প্রথম ডোজ কোভিশিল্ড, দ্বিতীয় ডোজ স্পুটনিক বা সিনোফার্ম নেওয়া যাবে?

ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এবং বাংলাদেশের করণীয়

দ. আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

দেশে করোনার নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়া রোধে করণীয়

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধা এবং আমাদের যত ভ্রান্তি!

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করে?

ভ্যাকসিন নিলেও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে?

ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি

৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ

Comments

The Daily Star  | English
Islami Bank's former managing director Abdul Mannan

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

7h ago