ইতালির চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি মিস করি: ড. এলিজা

এলিজা তুল্লিয়া বেরতুজ্জো। ছবি:পলাশ রহমান/স্টার

ইতালীয় গবেষক ড. এলিজা তুল্লিয়া বেরতুজ্জো। জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি। একাধিক বইসহ তার বহু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অনেক ম্যাগাজিনে। ঢাকার দ্য ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকায় তার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিতব্য বই— ৫০+ (স্বাধীনতার ৫০ বছর বিষয়ক) এ প্রবন্ধ লেখার জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

গত ১৬ জুন অধ্যাপক এলিজা তুল্লিয়া বেরতুজ্জোর সঙ্গে কথা হয় ইতালির জলকন্যা ভেনিসে। গর্ব করে তিনি বলছিলেন, ‘আমি ইতালির মেয়ে। কিন্তু, ইতালির চেয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশি বলতে পারি। বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ জীবন আমাকে আকর্ষণ করে। আমি বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়িয়েছি। বাংলাদেশের যত শহরে বা গ্রামে গিয়েছি, নিজের দেশ ইতালির অতগুলো শহর বা গ্রামে আমি যাইনি। আমি বাংলাদেশের গান পছন্দ করি। বাংলাদেশের ক্লাসিক গানগুলো অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কোনো বিকল্প পৃথিবীতে নেই।’

বাংলাদেশের সঙ্গে অধ্যাপক এলিজার সখ্যতা ১৫ বছরের পুরনো। গত ১৫ বছরে তিনি প্রায় ২০ বার বাংলাদেশে গিয়েছেন। ঢাকার একটা বস্তিতে থেকেছেন। হলি আর্টিজানে যখন ভয়াবহ হামলা হয়েছিল, তখনও তিনি ঢাকায় ছিলেন। ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রা বুঝতে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বস্তিবাসীর বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন।

ইতালির ভিচেনসা শহরের মেয়ে ড. এলিজা ছোটকাল থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বিদেশে যাবেন, বিদেশে পড়াশোনা করবেন। বড় সাংবাদিক হবেন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এসএসসি পাস করেই পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেখানে সমাজবিজ্ঞান ও গণযোগাযোগ বিষয়ে পড়াশোনা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার নগর জীবন বিষয়ে পিএইচডি করেন। বর্তমানে বার্লিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য ও নগর গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।

গবেষক এলিজা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের খাবার খেতে পছন্দ করি। বেশি ঝাল দিয়ে গরুর গোশত ভুনার কথা মনে পড়লেই জীবে জল এসে যায়। বাংলাদেশের সবজি ঘণ্টো, সর্ষে ইলিশ, পাকা আম, দই, রসমালাই আমার মতে বিশ্বসেরা।’

শুধু খেতেই পছন্দ করেন, রাঁধতে শেখেননি?

পারি তো। আমি জার্মানিতে আমার বাসায় মাঝেমধ্যে বাংলাদেশি খাবার রান্না করি। আমার বন্ধুরা খেয়ে প্রশংসা করে। ইতালিতে আমার পরিবারের মানুষদের, বন্ধুদেরও রান্না করে খাইয়েছি। সবাই খুব পছন্দ করেছে। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম। পড়াশোনার জন্য জার্মানি যেতে হলে তখন একটি বিশেষ পরীক্ষা দিতে হতো। আমার বাবা ভেবেছিলেন, আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারব না। কিন্তু, আমি একবারেই পাস করে যাই। বাবা নিজে ড্রাইভ করে আমাকে জার্মানির এক হোস্টেলে রেখে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য।

তাত্ত্বিক এলিজার চোখে-মুখে ফেলে আসা স্মৃতি খেলা করতে শুরু করে।

তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন খুব কড়া মানুষ। আমাদের দুই বোনকে খুব শাসনে রাখতেন। আমরা নিজেদের পরাধীন ভাবতাম। যখন জার্মানি যাওয়ার জন্য পরীক্ষায় পাস করলাম, আমার মা আপত্তি করেছিলেন। কারণ, আমি তখন মাত্র ১৮ পার করেছি। মা আমাকে ছোটই ভাবতেন।

লেখক এলিজা বার্লিনে পড়াশোনা শেষ করে সেখানের সংবাদপত্রে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ভাষাগত কারণে তা সহজ হয়নি। অল্পদিনেই তিনি বুঝে যান জার্মান ভাষার (তেদেসকো) সংবাদপত্রে তাকে কাজ দেওয়া হবে না। তিনি ফিল্ম ও ডকুমেন্টারি নির্মাণে মনোযোগ দেন। বার্লিনের একটি প্রতিষ্ঠানে কিউরেটর হিসেবে কাজ করেন। এরমধ্যে সুযোগ আসে গবেষণায় যোগ দেওয়ার। জার্মান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে সোজা চলে যান ঢাকায়।

২০০৫ সালে এলিজা প্রথম ঢাকায় আসেন গবেষণার কাজে। টানা তিন বছর গবেষণা করেন ঢাকা শহরের ওপর। ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রার ওপর।

এলিজার বই ‘ফ্রেগমেনটেড ঢাকা’।

সমাজবিজ্ঞানী এলিজা বলেন, ‘ঢাকার সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন বুঝতে আমি বস্তিতে থেকেছি। বর্ষাকালে মানুষ কেমন থাকে, কীভাবে থাকে, শীতের সময় কেমন থাকে, গরমের সময় কেমন থাকে, তা বুঝতে আমি প্রতি ঋতুতে বাংলাদেশে গিয়েছি।’

‘গত ১৫ বছরে আমি ঢাকার অনেক পরিবর্তন দেখেছি। লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষ বেড়েছে। এত অল্প জায়গায় এত বেশি মানুষ বসবাস করার উদাহরণ হতে পারে ঢাকা। আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি ঢাকার মানুষরা কীভাবে পাবলিক প্লেস (রাস্তা-ঘাট, পার্ক, ইত্যাদি) ব্যবহার করে। তাদের মনোজগতে কী খেলা করে। এত এত সংকটের মধ্যেও তারা কীভাবে সুখী থাকে।’

বাংলা-প্রেমিক এলিজার চোখে মুখে বেদনার ছাপ পরিষ্কার দেখতে পাই। তিনি বলতে শুরু করেন, ‘ঢাকায় মানুষ বাড়লেও মানুষের জীবনমান বাড়েনি। মানুষের নিরাপত্তা কমেছে। বড় বড় দালান কোটার ভিড়ে বুঝতে অসুবিধা হলেও সত্যি কথা হলো— ঢাকায় দরিদ্র মানুষ বেড়েছে। বড় লোকরা আর্থিকভাবে শুধু বড়ই হয়েছে।’

অধ্যাপক এলিজার মতে, ঢাকায় গরিব মানুষের ভিড় বাড়ার অন্যতম কারণ এনজিওগুলোর ঋণব্যবসা।

তিনি বলেন, ‘এনজিও বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো কাজ করেছে, যা সরকারের পক্ষে করাও অসম্ভব ছিল। কিন্তু, যে এনজিওগুলো মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করে, তাদের কাজ খুবই অমানবিক। গ্রামের বহু মানুষ এনজিওগুলোর ঋণ শোধ করতে না পেরে বাস্তুহারা হয়েছে। পালিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। ঢাকায় এসে তারা বেঁচে থাকার জন্য আবার ঋণ নিয়েছে। একটা ঋণ শোধ করতে তাদের আরেকটা ঋণ নিতে হয়েছে। এভাবে একেক জন মানুষ চার পাঁচটা ঋণের জালে আটকে গিয়েছে। তাদের স্বপ্নগুলো প্রতিদিন বিবর্ণ হয়েছে।’

এলিজা আরও বলেন, ‘যে মানুষগুলো এনজিওর ঋণে জড়িয়ে যায়, তারা মূলত বাধ্য হয়ে ঋণ নেয়। কারণ, তারা ব্যাংকে যেতে পারে না। ব্যাংক তাদের ঋণ দেয় না। তাদের দারিদ্র্যতার, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েই কিছু এনজিও ঋণের ব্যবসা করে। আমি বলবো— এগুলো খুবই অমানবিক।’

ঢাকার বস্তিগুলো মাদকের আখড়া, অন্যায়-অপরাধের অরণ্য, এই কথাগুলো একদমই মানতে চান না ড. এলিজা।

তিনি বলেন, ‘ঢাকার বস্তিগুলোকে এসব অপরাধের উৎস বলা ঠিক হবে না। অন্য ১০ জায়গার মতো বস্তিতেও অপরাধমূলক কাজ হয়। কিন্তু, সেগুলোকে কিছুতেই “উৎস” বলা যাবে না। অন্যায়-অপরাধ, মাদক বা নিরাপত্তাহীনতার উৎস খুঁজতে হলে অন্যদিকে নজর ঘোরাতে হবে।’

এলিজা বলেন, ‘আমি ঢাকার ওপর গবেষণা করেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করতে বাংলা ভাষা শিখেছি। বলতে, বুঝতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না। লিখতে, পড়তে পারলেও তা সহজ মনে হয় না। বেশ কঠিন লাগে।’

‘আমি ইতালির মেয়ে হলেও ইতালির চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি মিস করি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, খাবার আমাকে খুব টানে।’

অভিবাসীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইতালিতে জন্মের হার খুব কম। আগামী ৫০ বছর পরে ইতালির নেতৃত্ব দেবে অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা, যদি তারা ভালোভাবে নিজেদের গঠন করতে পারে।’

এলিজা বলেন, ‘ইতালির বাংলাদেশি অভিবাসীরা বেশ সৎ, কর্মঠ। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আমি ঢাকার বাসাবোয় অনেক বড় বড় বাড়ি দেখেছি যেগুলো ইতালিপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বানিয়েছেন। তাদের কারো কারো সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে।’

ভেনিসে বাংলাদেশি সবজির খেতে এলিজা। ছবি:পলাশ রহমান/স্টার

বাংলাদেশে যেতে কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি?

মুচকি হেসে এলিজা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে ভিসা নিতে অসুবিধা হয়েছে। তবে, এসব অসুবিধা বা জটিলতা গবেষকদের জন্য একদমই নতুন নয়। বিশেষ করে যারা সমাজবিজ্ঞান বা রাজনীতি নিয়ে কাজ করে, তাদের ভিসা দিতে অনেক দেশই জটিলতা করে। যারা অন্য বিষয় নিয়ে গবেষণা করে, তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। যেকোনো দেশ তাদের সহজে ভিসা দিয়ে দেয়।’

ভেনিসে এসেছিলেন কেন, বেড়াতে?

সাধারণত এই সময়ে আমি বাংলাদেশে থাকি। গত ১৫ বছর যাবৎ এমনটাই হয়েছে। কিন্তু, এবার যেতে পারিনি করোনা মহামারির জন্য। সময়টা কাজে লাগাতে ভেনিসে এসেছি। শুনেছি ভেনিসের বাংলাদেশি কমিউনিটি বেশ বড়। প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী এই স্বপ্নের শহরে বাস করেন। তাদের অনেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। ছেলে-মেয়েদের বিয়েও দিচ্ছেন। ভেনিসে বাংলাদেশিদের একটা সমাজ গড়ে উঠেছে। তাদের অনেকেই ব্যবসা করছেন, চাকরি করছেন, বাংলাদেশি সবজি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন। বিশেষ করে ভেনিসের পর্যটন এলাকা ও জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। ভেবেছি আপাতত বাংলাদেশে যেতে না পারলেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করা যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবন-যাপন নিয়েও গবেষণা করা যায়।

ভেনিসে এসে পরিচয় হয় বাংলা স্কুলের সভাপতি সৈয়দ কামরুল সরোয়ারের সঙ্গে। তিনি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। কবিরের রেস্তোরাঁয় অনেক সুস্বাদু বাংলাদেশি খাবার খেয়েছি। কয়েকটি বাংলাদেশি সবজির খেত ঘুরে দেখেছি। বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে স্থানীয় শ্রমিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি।

বাংলা-প্রেমিক এলিজা বলেন, ‘ঢাকার ওপর একটা ফিল্ম তৈরি করার ইচ্ছা আছে। এখনো পারিনি। কিন্তু, বই লিখেছি। আমার বইয়ের নাম ‘ফ্রেগমেনটেড ঢাকা’।

বাংলাদেশের কাছে কী প্রত্যাশা করেন?

বাংলাদেশ আমার ভালোবাসার দেশ। আমি চাই বাংলাদেশের সরকার আমাকে নাগরিকত্ব দেক। আমি যাতে আরও সহজভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পারি।

Comments

The Daily Star  | English
NBR speeds up auction process of abandoned goods

NBR moves to speed up auction of abandoned goods

About 2 lakh tonnes of imported goods left abandoned at Chattogram port alone for years

1h ago