তাঁতিদের নামে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে

ছবি: স্টার

ক্রমাগত লোকসানের বোঝা বহন করতে হলেও পৈত্রিক তাঁতের ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি পাবনার গয়েশপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ গ্রামের প্রান্তিক তাঁতি মোকারম হোসেন। তাঁত চালিয়েই কোনো রকমে দিনযাপন করছেন তিনি।

তার মতো প্রান্তিক তাঁতিদের জন্য শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা আছে সরকারের। এ সুবিধা ব্যবহার করে সুতা ও রঙের মতো কাঁচামাল আমদানিও করছে পাবনার বিভিন্ন তাঁতি সমিতি। তবে, যাদের নাম করে এ সুবিধা নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রান্তিক তাঁতিদের বেশিরভাগেরই এসবের কিছু জানা নেই। এ সুযোগে আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামাল বিক্রি করে দিচ্ছে একটি চক্র।

গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সদস্য মোকারম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তদের সমিতির ১৩০ জন তাঁতির ১২৯০টি তাঁতের বিপরীতে প্রায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করা হয়েছে। সমিতির বেশিরভাগ প্রান্তিক তাঁতি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি নিজেও কিছুদিন আগে কাঁচামালের কথা জানতে পেরেছেন।

তার ছেলে রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমদানি করা কাঁচামাল ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছে সমিতি। ফলে সরকারের শুল্কমুক্ত কাঁচামালের সুবিধা থেকে তাঁতিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার সুতা, সোডিয়াম সালফাইডসহ বিভিন্ন কাঁচামাল শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির অনুমতি পায় গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। এরপর এসব কাঁচামাল নিয়েও আসা হয়। প্রান্তিক তাঁতিদের নামে এতো কিছু হলেও তারা এসবের কিছুই জানতে পারেননি।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা আমদানি-রপ্তানি বিভাগের অফিস আদেশ থেকে জানা গেছে, চারটি শর্তে গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতিকে এ শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শর্তই হলো শুল্কমুক্ত এসব কাঁচামাল সমিতির ১৩০ জন তাঁতির ১২৯০টি তাঁতে ব্যবহার করতে হবে। এসব মালামাল কোথাও বিক্রি বা হাতবদল করা যাবে না।

কিন্তু, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি দালাল চক্র ওই সমিতির নেতাদের মাধ্যমে এসব কাঁচামাল আমদানি করে তা অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ প্রান্তিক তাঁতিদের বঞ্চিত করেছে।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৫১টি তাঁতি সমিতির নামে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার তাঁতের কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়।

তাঁত বোর্ডের পাবনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪৫ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয় পাবনা জেলার পাঁচটি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে। তবে সেখানকার প্রান্তিক তাঁতিরা এর কোনো সুবিধা পাননি।

পাবনা তাঁত বোর্ডের দোগাছি লিয়াজো অফিসের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজো অফিসার জাকির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকার প্রান্তিক তাঁতিদের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিলেও, তাঁতিদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র আমদানি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রান্তিক তাঁতিরা সুবিধা পাচ্ছেন না।’

পাবনার যে পাঁচটি সমিতি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করেছে সেগুলো হলো- গয়েশপুর ২ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, গয়েশপুর ৩ নং প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, আতাইকুলা ৬ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, দোগাছি ৩ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং একদন্ত ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি।

পাঁচটির মধ্যে তিনটি সমিতির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাঁচামালের কিছুই পাননি তাঁতিরা। সব কাঁচামাল অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। 

এই পাঁচটি সমিতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে গয়েশপুর ৩ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতি। কাঁচামাল না দিয়ে সমিতি থেকে তাঁতিদের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে সমিতিটির সভাপতি আয়ুব হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘শুল্ক ছাড়া যেসব কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তারমধ্যে পলিস্টার সুতা তাঁতিদের কাজে লাগে না। এ ছাড়া, এলসির মাধ্যমে আমদানির জন্য অপেক্ষা করার মতো সময় এবং অর্থ কোনটাই নেই প্রান্তিক তাঁতিদের।’

‘সাঁথিয়ার একজন ব্যবসায়ী আমাকে এলসির মাধ্যমে আমদানির কথা বলেন। তাঁতিদের লাভ হবে জানতে পেরে আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাই। সেই ব্যবসায়ী আমদানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এখানে তাঁতিদের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। আমদানির পর লভ্যাংশ হিসেবে ছয় লাখ টাকা আমাকে দেওয়া হয়। আমি সমিতির ৫৫৮ জন সদস্যের প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করোনাকালীন সহায়তা হিসেবে দিয়েছি।’

একইভাবে আতাইকুলা ৬ নং ওয়ার্ড প্রাথমিক তাঁতি সমিতির নামে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার তাঁতের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আকাশ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমাকে সাঁথিয়ার একজন ব্যবসায়ী এলসি সম্পর্কে বলেন।তবে আমি এর কিছুই জানি না। এলসি খোলা, আমদানি করার পুরো প্রক্রিয়ার জন্য আমার কোন জ্ঞান নেই। তিনিই সবকিছু করে পণ্য আমদানি করে তা বিক্রি করে লভ্যাংশ থেকে দুই লাখ টাকা সমিতিকে দেন। সমিতির ১৭২ জন সদস্যের মধ্যে ৭০০ টাকা করে লভ্যাংশ হিসেবে টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা নিয়ে তাঁতিদের বঞ্চিত করায় পাবনায় ভুক্তভোগী তাঁতিরা তাঁত বোর্ডে অভিযোগ করেছেন। তদন্ত করে এই অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার কামনাশিষ দাস।

কামনাশিষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তাঁতিদের জন্য সরকারের শুল্কমুক্ত সুবিধা এভাবে হরিলুট হওয়ায় তাঁত বোর্ড ইতিমধ্যে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। সরাসরি তাঁতিদের কাছে সরকারি সহায়তা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

3h ago