৩ নদীর তীব্র স্রোতে ভাঙন ঝুঁকিতে চাঁদপুর শহর
বর্ষা এলেই আতঙ্কে থাকেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। এ সময় পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে তীব্র স্রোত থাকে। ফলে, চাঁদপুর শহরের নতুন বাজার অংশের বড়স্টেশন মোলহেড ও পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ে।
গত তিন বছর ধরে তীব্র ঘূর্ণি স্রোত আঘাত হানছে এসব এলাকায়। এতে তীর রক্ষা বাঁধের পাথর ও আরসিসি ব্লক নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। পাউবো প্রতি বছর এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তা ফেলে সাময়িকভাবে রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তা তীব্র স্রোতে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে চাঁদপুর শহর ভাঙন ঝুঁকিতে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে শহরের নতুন বাজার অংশে বড়স্টেশন মাদ্রাসা রোড থেকে মোলহেডের পুরান লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে। প্রতিদিন তিন নদীর ঘূর্ণি স্রোতে এই এলাকার ব্লক বাঁধ ও পাথর নদীর তলদেশে তলিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা পুরানবাজার অংশের পুরানবাজারের উত্তর মাথায় ডাকাতিয়ার মুখ থেকে হরিসভা পর্যন্ত।
সরেজমিন দেখা গেছে, শহরের দুই অংশের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া, পশ্চিম অংশে মেঘনা ও পদ্মার মিলনস্থল বড়স্টেশন মোলহেড এলাকার বিভিন্ন স্থানে নদীর তীব্র স্রোতের কারণে ব্লক বাঁধ ডেবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে, এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাঝে মাঝে জিও ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
পাউবোর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহাকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমরা দাঁড়িয়ে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে এসব এলাকায় জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তা ফেলে যাচ্ছি। কারণ, এই নদীর তলদেশে তিন নদীর ঘূর্ণি স্রোত সৃষ্টি হয়ে বর্তমানে একশ থেকে দেড়শ ফিট গভীর হয়ে সব পাথর ব্লক সরে যাচ্ছে।
স্থানীয় পাউবো কর্মকর্তারা জানান, এভাবে বছরের পর বছর বর্ষার সময় নদীতে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হয়ে চাঁদপুর শহর চরম হুমকির মুখে পড়েছে। ২০১৯ সালে পাউবো থেকে সরেজমিনে স্টাডি করে ৪৫০ কোটি টাকার স্থায়ী একটি প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে চাঁদপুর শহরের দুই অংশে নদীর পাড় আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এর কারণ ও করণীয় নিয়ে গবেষণা করে নদী ভাঙন প্রতিরোধ জরিপকারী বিশেষজ্ঞ দল। তারা চাঁদপুর শহর রক্ষায় নতুন করে তিন হাজার কোটি টাকার আরেকটি দীর্ঘ স্থায়ী প্রকল্প জমা দেন। কিন্তু, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো প্রকল্প পাস হয়নি। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া দেওয়া হয়নি। তবে, ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিলে মাঝে মাঝে পাউবো স্থানীয় সাংসদের চাপে পড়ে কিছু থোক বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তারা সেখান থেকে এসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কিছু বালির বস্তা ফেলে সাময়িক ভাঙন প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।
এদিকে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম রেফাত জামিল বলেন, ‘আমরা এই বড়স্টেশন মোলহেডসহ শহর রক্ষা ও তীর রক্ষায় ১৯৭২ সাল থেকে ১৬৪ কোটি ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয় করেছি। এর মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে ব্যয় হয়েছে ২৪ কোটি ৯০ হাজার টাকা। তিন নদীর মোহনা বা মোলহেডটি বর্তমানে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে এখানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন স্থাপনা ও বসার স্থান নির্মাণ করে পর্যটন নগরীতে পরিণত করেছে।’
গত সপ্তাহে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সরেজমিন এসে এই স্থানকে আরও আকর্ষণীয় করতে কোটি টাকা ব্যয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার দেখাদেখি গত ১৯ জুন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) চাঁদপুরের এই স্থানটিকে পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও এতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু, রেল কর্তৃপক্ষ এই জায়গাটি তাদের নিজস্ব জায়গা দাবি করে ঝুঁকিপূর্ণ মোলহেডের মাত্র ২০০ গজের ভেতর ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে আধুনিক ১ হাজার ৩০০ ফিট রেলস্টেশনের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পাঁচশ ফিট কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু, বাকি আটশ ফিট রেললাইন করার জমি অবৈধভাবে দখলে থাকায় এখনো শুরু হয়নি বলে দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রেল কর্মকর্তা।
বড়সেটশন মোলহেডের পাশেই মাদ্রাসা রোড এলাকায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক লঞ্চ টার্মিনালসহ নদী বন্দর করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এসব স্থাপনা ছাড়াও রেলস্টেশন সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে বিআইডাব্লিউটিসির স্টিমার ঘাট,দেশের সর্ববৃহত ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র বা মাছ ঘাটসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শতশত ঘরবাড়ি এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে।
এছাড়া, পুরানবাজারের দক্ষিণাংশে মেঘনার পাড়েই সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু, নদীর এই ভয়াবহ অবস্থার বিষয়টি তাদের কেউ মাথায় নিচ্ছেন না।
নদী ভাঙন প্রতিরোধ গবেষকরা তাদের স্টাডিতে বলেন, চাঁদপুরের পদ্মা, মেঘনার পশ্চিমাংশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য চর পড়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে চাঁদপুর শহরের দিকে চলে এসেছে। বর্তমানে ১৮ কিলোমিটার চওড়া মেঘনা নদীটি সংকুচিত হয়ে মাত্র দেড় কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। তবুও এই দেড় কিলোমিটার চাঁদপুর শহরের পাশ দিয়ে যাওয়ায় পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর স্রোত বার বার চাঁদপুর শহর রক্ষা প্রকল্পে আঘাত হানছে। আবার পশ্চিম দিক থেকে পদ্মার অংশও সরাসরি চাঁদপুর শহরের দিকে এসে মিলিত হওয়ায় এর ভয়াবহতা আরও বেড়েছে।
চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে এবার হয়তো শেষ রক্ষা হবে না। কারণ বড়স্টেশন মোলহেডের যে নড়বড়ে অবস্থা তাতে মুহূর্তের মধ্যে সেটি তলিয়ে গেলে ব্যবসা কেন্দ্রসহ পুরানবাজারও চোখের পলকে বিলীন হয়ে যাবে। এতে পুরানবাজারের অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি মিল ইন্ডাস্ট্রিসহ প্রায় আড়াইশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। আর্থিকভাবে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিসহ হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। এ বিষয়ে এখনই সরকারের স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
চাঁদপুর বিআইডাব্লিউটি-এর উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম বলেন, ‘তিন নদীর স্রোতে বড়স্টেশন মোলহেড ভেঙে গেলে চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনাল, ডাকাতিয়া নদীর পাড়ের স্টিমার ঘাটসহ বিআইডাব্লিউটি-এর ব্যাপক ক্ষতি হবে।’
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চাঁদপুর শহর রক্ষায় প্রয়োজন জরুরিভিত্তিতে চরগুলো কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষায় তিন হাজার ৩৬০ মিটার এলাকায় স্থায়ীভাবে প্রকল্প নিয়ে এখনই কাজ শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে যে কোনো মুহূর্তে চাঁদপুর শহরের অর্ধেকসহ এই সরকারের আমলে করা ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চাঁদপুর-হাইমচর রক্ষা বাঁধও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, ‘নতুন করে এই আতঙ্ক আমাদের তাড়া করছে। এ জন্য আমাদের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এই মোলহেড ও চাঁদপুর শহর রক্ষায় নতুন একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করি তিনি সফল হবেন এবং আমরা আবারও নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পাব।’
Comments