‘শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, সামাজিকভাবেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে’

কেবল রাষ্ট্রই নয়, বিভিন্ন নন-স্টেট অ্যাক্টরও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার।
অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার

কেবল রাষ্ট্রই নয়, বিভিন্ন নন-স্টেট অ্যাক্টরও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার।

শনিবার বিকেলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জে’ শীর্ষক আনলাইন বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। এটি ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিলিয়া আয়োজিত বক্তৃতামালার চতুর্থ বক্তৃতা।

অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘ইতিহাসে “সকলের জন্য” মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। মতপ্রকাশের অধিকার কেবল ক্ষমতাসীন অভিজাতদের জন্য একচেটিয়াভাবে সংরক্ষিত ছিল। ইউরোপে রেনেসাঁ, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং পরবর্তীকালে আমেরিকান স্বাধীনতা, ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে সকলের জন্য মতপ্রকাশের অধিকারের ধারণা সামনে আসে এবং ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের মাধ্যমে তা সাধারণ স্বীকৃতিলাভ করে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সনদসমূহে বিধৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংজ্ঞায় আলোচনা কেবল নাগরিকের অধিকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক লঙ্ঘনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতির যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ভিন্ন ধর্ম তো বটেই, নিজের আচরিত ধর্ম নিয়েও কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। “আমাদের/চিরায়ত/নিজস্ব” সংস্কৃতি এবং প্রত্যাশিত সামাজিক আচার-আচরণের নামেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। যারা শালীনতার নামে নারী অধিকারের উপর ভয়াবহ হস্তক্ষেপ করছে, তারা প্রথমে নমনীয় প্রচারের কৌশল নিলেও বিরোধিতার মুখে ভেড়ার আড়ালে বাঘের চেহারা নিয়ে হাজির হয়। হেডমাস্টার, স্কুল কমিটি সভাপতি, স্থানীয় সরকারের কর্তাব্যক্তি, কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শিক্ষার্থীদের হেয়ার স্টাইলের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের আরোপিত সামাজিক সমন্বয়ের চেষ্টা “মোরাল পুলিশিং” মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ভয়াবহ লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।’

মূল বক্তৃতায় অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। সরকার দাবি করছে, জনগণের ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং তরুণরা যাতে বিপথে না যেতে পারে এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হয় তার জন্য এরকম আইনের প্রয়োজন রয়েছে। তাতে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা কমছে না। সরকারের উচিত সেই ভয় তাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া এবং এটা মাথায় রাখা যে, কোনো আইনের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা মানেই সেই আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা নয়।’

আজকের অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। স্বাগত বক্তৃতা ও সভাপতিত্ব করেন যথাক্রমে বিলিয়ার পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও বিলিয়ার চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম।

পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘পাকিস্তানে সমাজতন্ত্রের কথা বললে জেলে নেওয়া হতো, ছয় দফা ঘোষণার পর প্রতিটি সমাবেশের পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হতো। আমরা স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছি। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, কিন্তু তার দল আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে চারটি জাতীয় সংবাদপত্র চালু রাখার পরামর্শ তোয়াব খান প্রমুখ সিনিয়র সাংবাদিকরাই দিয়েছিলেন। এরশাদের সময় ‘হরতাল’ শব্দটি উচ্চারণ করা যেতো না, সংবাদপত্রে আমরা লিখতাম ‘কর্মসূচি’, ‘দুর্ভিক্ষে’র পরিবর্তে লিখতে হতো ‘ভিক্ষার অভাব’। তবে স্বাধীনতা, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে জাতীয় স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজের সূচকে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে ‘পার্শিয়ালি ফ্রি কান্ট্রি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। তাছাড়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আইন প্রণেতা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমলা ও সাংসদদের তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছে। আমাদের অনেক বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি হয়নি। সম্প্রচার নীতিমালা থাকলেও সম্প্রচার আইন নেই।

Comments

The Daily Star  | English
Cox’s Bazar Rail Station

Cox’s Bazar Rail Station: A modern marvel awaits travellers

The recently constructed Cox’s Bazar rail station aims to attract more tourists to the country’s renowned destination, the Cox’s Bazar sea beach.

17h ago