বিনা অপরাধে জেলে ২৪ বছর ‘আমার জীবনডা কেডা ফিরাইয়া দেবে?’

‘আমি তহন ক্লাস ফাইভে পড়ি, দারোগা স্কুল থেইক্যা আমারে ধইরা আইনা কয়, “তুমি বলো, বাচ্চাডারে ধাক্কা মাইরা খালে হালাইছ।” আমি হের কথা মতো কইলে, হেরা আমারে জেলখানায় আনে। আমার আর কিছু মনে নাই’, বলছিলেন পিয়ারা আক্তার।
পিয়ারা আক্তার। ছবি: সংগৃহীত

‘আমি তহন ক্লাস ফাইভে পড়ি, দারোগা স্কুল থেইক্যা আমারে ধইরা আইনা কয়, “তুমি বলো, বাচ্চাডারে ধাক্কা মাইরা খালে হালাইছ।” আমি হের কথা মতো কইলে, হেরা আমারে জেলখানায় আনে। আমার আর কিছু মনে নাই’, বলছিলেন পিয়ারা আক্তার।

টানা ২৪ বছর বরিশাল জেলা কারাগারে দণ্ড ভোগ এবং বিশেষ বিবেচনায় চার বছরের সাজা মওকুফের পর গত ১০ জুন কারামুক্ত হয়েছেন তিনি।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় আমাকে ২৪ বছর জেল খাটানো হয়েছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমার জীবন কেডা ফিরাইয়া দেবে?’

দীর্ঘদিন কারাবাসের কারণে তার কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছে বাইরের জগৎটা। চিনতে পারেন না আত্মীয়-স্বজনদের।

পিয়ারা আক্তার ডেইলি স্টারকে জানান, চাচা জিয়াউল হকের সঙ্গে তাদের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। তার সাত-আট বছর বয়সী চাচাতো বোন মারা গেলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তার নামে মামলা দেন চাচা। সে সময় প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন পিয়ারা। দারোগা তাকে যা শিখিয়ে দেয়, তাই বলেন তিনি। তারপর থেকে পিয়ারার জায়গা হয় বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে।

২৪ বছর কারাগারের কাটানোর পর বাইরের পরিবেশ আর অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনের কথা ভুলে গেছেন তিনি। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান পিয়ারার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি কেউ। ছাড়া পাওয়ার দিনও তাকে নিতে যায়নি কেউ।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ নিয়ে নারী ওয়ার্ডে ২৪ বছর কাটানোর পর ভালো আচরণের জন্য চার বছর সাজার মেয়াদ কমিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

‘মুক্তি পাওয়ার পর সমাজসেবার লোক আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসলেও কাউরে চিনতে পারিনি। সব মানুষই আমার অপরিচিত লাগে। আমার মাথায় কোনো কিছু নাই, ছোটবেলার কথা সামান্যই মনে আছে’, বলেন পিয়ারা।

পিয়ারা আক্তারের মুক্তির দায়িত্বে থাকা বরিশাল নগরীর সমাজসেবা বিভাগের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘পিয়ারা আক্তারের বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ছোট হাজি গ্রামে। খুব ছোট থেকেই সে সাজা খাটছে, আগের কথা বিশেষ মনে নেই। তার আচরণ ভালো থাকায় আমরা সাজা কমিয়ে মুক্তির আবেদন করলে আবেদন গৃহীত হয়।’

জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘পিয়ারা বেগমের কেসটা শুনে আমি দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। ক্লাস ফাইভের বাচ্চার তো এই আদালতে বিচার হওয়ার কথা নয়। আমার মনে হয় তার বয়স বাড়তি দেখানো হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুধু তার মুক্তি নয়, তাকে একটি বাড়ি ও একটি চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আল মামুন বলেন, ‘পিয়ারা আক্তারের ফাইলে তার কোনো বয়স লেখা নেই। তবে তার আচরণ ভালো হওয়ায় জেল কর্তৃপক্ষ মুক্তির জন্য আবেদন করলে ২৪ বছর দণ্ড খেটে গত ১০ জুন সে মুক্তি লাভ করে। সে জেলে টেইলারিংয়ের কাজ শিখে সুনাম অর্জন করেছে।’

পিরোজপুর জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক শামীম ইকবাল বলেন, ‘জেলখানার কেস হিস্ট্রিতে সে হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ শফিকুল ইসলামের রায়ে তিনি ১৯৯৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দণ্ডপ্রাপ্ত হন। কেস ডকেটে তার বয়স লেখা আছে, তখন ১৮ বছর ছিল।’

পিয়ারা আক্তার জানান, এতদিন কেউ তার সঙ্গে দেখা করেননি। তার বাবা অনিস মৃধা আগেই মারা গেছেন। ভাই ইউনুস মৃধা ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, তিনিও কিছু করতে পারেননি।

জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘তিনি এখনও কিছুটা ট্রমাটাইজড আছেন। স্থির হতে একটু সময় লাগবে।’

বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা এই ঘটনা শুনেছি। যদি এর পেছনে কোনো পুলিশের ভূমিকা পাওয়া যায়, তার কোনো ক্ষমা নেই। ঘটনাটি আমরা তদন্ত করে দেখছি।’

পেয়ারা বেগমের মামলাটির আনুপূর্বিক তদন্ত দাবি করছেন বরিশালের সচেতন নাগরিক কমিটির আহবায়ক শাহ সাজেদা।

Comments

The Daily Star  | English
Rice price in Bangladesh is rising and the rate of coarse grain has crossed Tk 50 a kilogramme nearly after a year

How much do the poor pay for rice? At least Tk 50 a kg

Rice price in Bangladesh is rising and the rate of coarse grain has crossed Tk 50 a kilogramme nearly after a year

6h ago