‘দুর্নীতিবাজদের বার্তা, লিখলে এভাবেই মামলা-গ্রেপ্তার করা হবে’

হাসপাতালে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় ভর্তি তানভীর হাসান। ছবি: সংগৃহীত

দিনে বরাদ্দ ৩০০ হলেও করোনা রোগীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে ৭০ টাকার। ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের এমনই দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সাংবাদিক তানভীর হাসানকে।

পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পরলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেও হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।

তানভীর হাসানকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হলেও সেটি খারিজ করে তার জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ রোববার বিকালে ঠাকুরগাঁওয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুর রহমানের ভার্চুয়াল আদালত এ আদেশ দেন।

ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল নিয়ে তানভীর হাসানের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, ‘একজন রোগীকে তিন বেলা যে খাবার দেওয়া হচ্ছে তার বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৮০ টাকার বেশি নয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফলমূল দেওয়ার কথা থাকলেও তা পাচ্ছেন না রোগীরা। ফলে বেশিরভাগ রোগীকেই বাড়ির খাবারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।’

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও মনসুর আলী। ছবি: সংগৃহীত

তার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘খাবার সরবরাহে করোনা ইউনিটে দর্শনার্থীর আনাগোনায় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে।’

এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নাদিরুল আজিজ বাদী হয়ে সাংবাদিক তানভীর হাসান, রহিম শুভ্র ও আবদুল লতিফ লিটুর নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী অনুযায়ী ‘একে অপরের যোগসাজশে ওয়েব সাইটের ডিজিটাল বিন্যাসের মাধ্যমে মিথ্যা, মানহানিকর তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে মানহানি ও বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপরাধে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি মনসুর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখানে ঘটনাটি ঠিকাদারকে নিয়ে। হাসপাতালের তো কোনো বিষয় না। খাবার সরবরাহ করেছে ঠিকাদার। সে অনিয়ম করলে হাসপাতাল তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। তা না করে উল্টো অনিয়ম দেখিয়ে দেওয়া সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন, এটা কোন আইনে আছে?’

হাসপাতালটিকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষ করোনা ইউনিটে অবাধে যাওয়া আসা করে। এভাবে করোনা রোধ করা যাবে? নিশ্চিত করোনা রোগীদের সঙ্গে চলাফেরা করে বাকীরা এই ভাইরাস আরও ছড়িয়ে দিচ্ছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে?’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে কালো আইন বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘এটা মানুষের আইন না। এটা কালো আইন। অবিলম্বে এই আইন বাতিল করা দরকার।’

‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সরকার কোনোরকম হস্তক্ষেপ করছে না। বর্তমান সরকারের সময় সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে’-জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কথাগুলো বলেছিলেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।

বাস্তবতায় দেখা যায়, ফটোসাংবাদিক কাজলের পিঠমোড়া করে বাধা হাতে হ্যাণ্ডকাফ, কুষ্টিয়ায় যুবলীগ নেতার করা তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাংবাদিক মুন্সী শাহীন আহমেদ জুয়েল ও অঞ্জন কুমার শীল শুভ কারাগারে, খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সী গ্রেপ্তার, হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় হ্যাণ্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় হাসপাতালে ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক তানভীর হাসানকে।

সম্প্রতি প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির সময়েও ৮৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এই আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক মারা গেছেন কারাবন্দী অবস্থাতেই।

সংবাদমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার অংশ হিসেবেই তানভীর হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘প্রতিবেদনটি আমি পড়েছি। সেখানে ডাক্তাররা কেউ এই অভিযোগটি অস্বীকার করেননি। একজন বলেছেন, ঠিকাদার যা সরবরাহ তরে আমরা তাই রোগীদের দেই। আরেকজন বলেছেন, তদন্ত করে দেখবেন। এই সংবাদের কারণে যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় তাহলে বাংলাদেশে কেউ সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। এটা নিয়ে তো সাধারণ মামলাই হতে পারে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তো দূরের কথা।’

এই মামলাকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন আমরা বরাবরই চাচ্ছি। যতদিন সংশোধন না হচ্ছে ততদিন এর প্রয়োগ বন্ধ রাখার দাবিও আমরা জানিয়ে আসছি।’

এই মামলাটি একেবারে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ আছে ৩০০ টাকা, আর খাবার দেওয়া হচ্ছে ৭০ বা ৮০ টাকার। এটা তো একজন সাংবাদিকের খুব সাধারণ অবজারভেশন। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকারকে আরও সাহায্য করা হয়েছে। সরকারের খরচ হওয়া টাকা যথাযথভাবে খরচ হচ্ছে কিনা সেটাই তো এই সাংবাদিক তুলে ধরলেন। সরকারকে বুঝতে হবে, এই সাংবাদিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, দুর্নীতিবাজ ডাক্তার বা কর্মচারী বা যারাই আছেন তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এভাবে গ্রেপ্তার করা হলে নিশ্চিতভাবেই বোঝা যায় যে, এটা দুর্নীতিবাজদের একটা বার্তা— আমাদের বিরুদ্ধে লিখলে এভাবেই মামলা-গ্রেপ্তার করা হবে।’

এই প্রতিবেদনের তথ্যভিত্তিক যাচাই করা সরকারের প্রথম কাজ বলে মনে করেন মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। যদি প্রতিবেদনের তথ্য সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus rules out referendum over July Charter

Chief adviser insists party agreement key to polls; vows justice, reform ahead of election

Now