মুক্তিযুদ্ধ

১১ জুলাই ১৯৭১: কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের ৭ দিনের সম্মেলন

১৯৭১ সালের ১১ জুলাই কলকাতাস্থ ৮ নং থিয়েটার রোডের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে সেক্টর কমান্ডারদের ৭ দিন ব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সম্মেলনের শুরুতে কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধে ওয়ার কমান্ড কাউন্সিল গঠনের দাবি জানান।

এইদিন প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার সুপারিশ করা হয়। অনেকে এই দাবির স্বপক্ষে থাকলেও মেজর খালেদ মোশাররফ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, এই ওয়ার কাউন্সিল গঠনের নাম করে এখন কর্নেল ওসমানীকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সি আর দত্ত এই প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকবেন না বলে ঘোষণা দেন। অন্যদিকে এই প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানী বিরোধিতা করেন এবং একপর্যায়ে পদত্যাগ করেন। তারপর সভা থেকে বেরিয়ে যান। যদিও তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি এদিন।

সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী ছাড়াও মন্ত্রিসভার সব সদস্য, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব, গ্রুপ, ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর সিআর দত্ত, মেজর খালেদ মোশাররফ, উইং কমান্ডার এম কে বাসার, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর এ আর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ও মেজর এম এ জলিলসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমদিনের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

ভারতে এদিন

১১ জুলাই কলকাতার রাজভবনে ভারতের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, 'ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানকে বিন্দুমাত্র চটাতে চায় না। ভারত যদি এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তবে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধে জড়াবে। তখন আমাদের ওপরেই আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি আমরা এখনো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। পাকিস্তানের ওপরে এখনো সেই অর্থে কোনো আন্তর্জাতিক চাপ নেই। হাতেগোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া সব দেশই এখনও পাকিস্তানের পক্ষে। এই মুহূর্তে আমরা যদি জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করি তবে তা সাড়া ফেলবে না। তাই ভারত এখনই জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করতে চায় না। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। তবে তা কিছুটা সময় সাপেক্ষ।'

১১ জুলাই রাজস্থানের উদয়পুরে ভারতে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত উজামা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলার বিষয়ে ভারত সরকারের উদারনীতি খুবই আশাব্যঞ্জক। জাপান আশা করে ভারতের এই উদারনীতি বলবৎ থাকবে।

পাকিস্তানে এদিন

১১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর শেষে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়। বৈঠক শেষে এদিন রাতে হেনরি কিসিঞ্জার তেহরানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ছেড়ে যান।

১১ জুলাই পাকিস্তানের লাহোর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে পিডিপি’র সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান বলেন, 'একটি ইরানি সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো যে মীমাংসার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য ফর্মুলা দিয়েছে তা কেবল লজ্জাজনকই নয় বরং বিপজ্জনকও বটে।

বে-আইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তান সরকারের কোনো প্রকার মীমাংসাভিত্তিক ফর্মুলার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করা উচিত হবে না। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ। যেই আওয়ামী লীগের সাথে পাকিস্তানের আলোচনা করতে যাবে তিনিই জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ করবেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীত দল বিটলস এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, 'ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে আগামী পহেলা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনসে একটি কনসার্ট করছি আমরা। পন্ডিত রবিশঙ্করই আমাদের অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা।' পন্ডিত রবিশঙ্কর বিটলসের সাবেক সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থীদের বিষয়ে একটি দাতব্য সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনের কথা বলেন। এসময় হ্যারিসন দুই বছর আগে ভেঙে যাওয়া বিটলসের সাবেক সদস্যদের এই দাতব্য অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার অনুরোধ করেন। জানা যায় বিটলসের সাবেক সদস্য পল ম্যাকার্টনি মূল দলের সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক না থাকায় আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পন্ডিত রবিশঙ্কর এক বিবৃতিতে এদিন বলেন, এই কনসার্ট থেকে আয় করা সমস্ত অর্থ ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য ইউনিসেফের তহবিলে দান করা হবে।

১১ জুলাই প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যমে সানডে টাইমস একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে সানডে টাইমসের সাংবাদিক মারে শেলি বলেন, 'পাকিস্তান দাবি করছে পূর্ববঙ্গ এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল ও শান্ত। যা পুরোদস্তুর মিথ্যা। দলে দলে এখনো নিরীহ সাধারণ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। আমি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখেছি। যেখানে গ্রামবাসী তীব্র উৎকণ্ঠায় বসবাস করছে। পাকিস্তান সরকার নিরীহ মানুষকে পাখির মতো হত্যা করছে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য এর পরেও ক্রমাগত পাকিস্তান সরকার মিথ্যাচার করেই যাচ্ছে। পূর্ববঙ্গে যা হচ্ছে তা কল্পনাতীত।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১১ জুলাই কুমিল্লায় সকাল ৮টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামান ও গোলা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর শালদা নদী অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। সারাদিন গুলাগুলি শেষে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষতিসাধন নয়। হানাদারদের গুলিতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের হাবিলদার তাজুল মিয়া ও সিপাই আব্দুর রাজ্জাক মারাত্মকভাবে আহত হন। তাছাড়া দুই জন বেসামরিক লোক নিহত ও ৮ জন আহত হয়।

১১ জুলাই কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারের দিকে যাওয়ার সময় সকাল ১১ টার দিকে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের মুখে পড়ে। এই সময় দুই দলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১৫ জন সৈন্য এসময় নিহত হয়। পাকিস্তানি হানাদারেরা চার ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে পিছু হটে ফিরে যায়।

১১ জুলাই খুলনার পাইকগাছায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় রাজাকার ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনী নিরাপদে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন করে।

১১ জুলাই চাঁদপুরে বিকেল সাড়ে ৬ টায় মুক্তিবাহিনীর ২ গেরিলা সদস্য চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২ হানাদার সেনা ও ২ পুলিশের উপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এসময় চার জনই নিহত হয়।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, দশম, দ্বাদশ ও চতুর্দশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ১২ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১২ জুলাই ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments