‘পরিস্থিতির সঙ্গে লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক’
ঈদুল আজহা উদযাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ-পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলমান বিধি-নিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত থাকবে এই শিথিলতা। দেশে যখন করোনা শনাক্ত ও আক্রান্তদের মৃত্যু প্রায় প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে রেকর্ড ভাঙছে, তখন এই শিথিলতা প্রশ্নের সম্মুখীন।
চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুই হাজার ৩৩৯ জন। যা দেশের মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত ১১ জুলাই করোনায় একদিনে সর্বোচ্চ ২৩০ জনের মৃত্যু দেখেছে দেশ।
শনাক্তের দিক থেকেও একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছে জুলাইয়ে। গত ১২ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৬৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই ১৩ দিনের মধ্যে শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৭ জন। যা দেশের মোট শনাক্তের ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
শনাক্ত ও মৃত্যুর যখন এমন পরিসংখ্যান, তখন লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়েছে কোন বিবেচনায়? জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের সঙ্গে।
শনাক্ত ও মৃত্যুর এমন ঊর্ধ্বমুখী সময়ে লকডাউন শিথিলতার কারণ জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘লকডাউনের নামে যা চলছে, এগুলো তো আসলে লকডাউন না। লকডাউনের মধ্যে যানজট, লকডাউন শিথিল, লকডাউন হাফ, লকডাউন ঢিলেঢালা—এসব নিয়ে নানা কথা প্রচলিত হয়ে গেছে। আমাদের মতো দেশে আসলে দীর্ঘসময় লকডাউন দেওয়া খুব কঠিন। আর লকডাউনটা কোনো স্থায়ী সমাধানও নয়।’
ঈদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘মানুষ ঈদের আনন্দ করবেন, কোরবানি দেবেন। অনেক মানুষ পশু পালন করছেন এই ঈদে বিক্রি করবেন বলে। এখান থেকে যে আয় হবে, তা দিয়েই তিনি সারা বছর চলবেন। কাজেই অর্থনীতির এই বিষয়গুলোও সরকারের দেখতে হয়।’
‘গত ঈদে গাড়ি বন্ধ থাকায় মানুষ ভেঙে ভেঙে বাড়ি গেছেন। এ সময় তারা নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন, অপরকে সংক্রমিত করেছেন, বাড়ির মানুষের জন্যে করোনা বয়ে নিয়ে গেছেন। কাজেই গাড়ি চলাই তো ভালো। তবে, স্বাস্থ্যবিধি যেন কঠোরভাবে মানা হয়।’
সব ধরনের মানুষের কথা মাথায় রেখে সরকারের এমন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় বলে উল্লেখ করে প্রত্যেককে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তার মতে, একমাত্র টিকাই পারে এই পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে।
ঈদুল আজহার এই সময়ে কোরবানির পশু কেনার সময় থেকে শুরু করে গোশত বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিজের ও অপরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
লকডাউনে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেছে কি না এবং তাদের কথা চিন্তা করেই লকডাউন শিথিলের মতো পরিকল্পনা করা হয় কি না, জানতে চাইলে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন খাতে কেনাকাটা সংক্রান্ত দুর্নীতির উদাহরণ দিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আশ্রয়হীন মানুষের জন্যে প্রধানমন্ত্রী ঘর দিলেন, সেগুলোও ছয় মাসের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষ নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। আপনি চাইলেই তো সব পারবেন না। সব জায়গাতে অযোগ্যতা আর অদক্ষতা দিয়ে ভর্তি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই, চাকরি নেই। বেসরকারি চাকরিজীবীদের কারো চাকরি চলে গেছে, কারো অর্ধেক বেতন, অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। খালি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরামে আছেন, বেতন পান। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ তো বলেনই—আমরা করোনায় মরব না, আমরা মরলে না খেয়ে মরব। অনেকে এমনও বলেন—আমরা করোনায় মরতেও রাজি আছি, কিন্তু, পরিবার নিয়ে এভাবে আর ক্ষুধার কষ্ট করতে পারছি না।’
লকডাউনে শিথিলতা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে একুশে পদক-বিজয়ী চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সরকার কারিগরি কমিটির পরামর্শ নিয়েছে কি না, সরকার জানে। আমি আমার মতামত দিয়েছি। আমি সবসময়ই বলেছি, ঈদে যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। বাড়িতে না যাওয়াই শ্রেয়।’
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘পরিস্থিতির সঙ্গে লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক।’
সরকারকে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করতে হয় বলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি জীবিকার কারণে জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়, তাহলে সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায়।’
কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সে ব্যাখ্যা এখনো পাননি জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘কোরবানিকে ঘিরে দেশের অর্থনীতির চাকা যে প্রবর্তিত হয়, সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে হয়তো সরকারকে একটি কম্প্রোমাইজের জায়গায় যেতে হচ্ছে।’
এমন কম্প্রোমাইজের জন্যে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করতে গিয়ে ভুল হতে পারে। আর ভুল হলে তার মাশুলও দিতে হতে পারে। সাধারণভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এতে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে। আর সংক্রমণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুও বাড়বে।’
মৃত্যু বাড়ার কারণ দেশে অক্সিজেনের ঘাটতি ও সংক্রমণ বাড়লে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন ডা. ইকবাল আর্সলান।
লকডাউনে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে নিম্ন আয়ের মানুষ বা হতদরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের কোনো তালিকা বা তাদের চিহ্নিত করার কোনো টুলস আমাদের নেই। এ কারণেই রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিবেচনায় দরিদ্রদের বরাদ্দ চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আমরা পাই। সরকারের কাছে আমরা যেভাবে আশা করি, তা না হওয়ার এটা একটা বড় কারণ হতে পারে।’
‘লকডাউনের দিনগুলোতে যাদের আয় বন্ধ, তাদের কথা হয়তো সরকারের বিবেচনায় আছে বলেই শিথিলতার দিকে যাচ্ছে বা বাধ্য হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘একটি রাষ্ট্রের ওপর অনেক দায়িত্ব থাকে। সরকার বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে এই শিথিলতার পথে যাচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো অনেক বেশি সংবেদনশীল। সৌদি আরব ঈদুল আজহার সময়েও কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশে সেই সামাজিক অবস্থা তৈরি হয়নি, যেখানে আমরা বৃহৎ স্বার্থে মানুষকে ঈদের আমেজ থেকে দূরে রাখতে পারব।’
তিনি জানান, ঈদুল আজহায় দেশের মানুষের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাও রয়েছে এবং পশুর ক্রেতা-বিক্রেতারা সরাসরি হাটেই যেতে চান। করোনার এই সময়ে পশুর হাটের বিকল্প পরিকল্পনা আগে থেকেই করে রাখা উচিত ছিল বলে যোগ করেন তিনি।
দেশে নতুন দরিদ্র শ্রেণি তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মানুষগুলো রাজধানীর বুকে মেসে থাকেন। কিন্তু, তাদের পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। এই মানুষগুলো পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবেনই। সীমিত আকারে গণপরিবহন চালু করা না হলে এই মানুষগুলো জীবন বাজি রেখে হলেও কীভাবে বাড়ি ছুটে যান সেটা আমরা দেখেছি।’
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে সামাজিক পরিবর্তন আনতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, সমাজকর্মীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এই মানুষদের সম্পৃক্ত করতে পারলে করোনা রোধ করা আমাদের জন্যে সহজ হবে।’
লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত আমাদের সক্ষমতা পরিমাপ করা। যেসব দরিদ্র মানুষ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ছিলেন, তারা সহায়তা পাচ্ছেন। কিন্তু, নতুন দরিদ্র যারা হয়েছেন, তারা এর বাইরে। এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের অবস্থাও ভালো নয়। তারা আত্মসম্মানের কারণে কারো কাছে হাত পাততেও পারছেন না। তাদের জন্যে অর্থমন্ত্রী এবার কোনো মেকানিজম করেছেন বলে দেখিনি।’
আজ মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে লকডাউন শিথিল করা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসজনিত রোগ সংক্রমণের পরিস্থিতি বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে ২৩ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো।
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে আগামী ২১ জুলাই।
অর্থাৎ, এবার ঈদের যারা বাড়ি যাবেন, তাদের পুনরায় কর্মস্থলে ফিরতে হবে ঈদের পরের দিন ২২ জুলাইয়ের মধ্যেই। কেননা, ২৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিধি-নিষেধে বন্ধ থাকবে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটসহ) ও সব ধরনের যানবাহন চলাচল।
Comments