শ্রদ্ধাঞ্জলি

এ পি জে আবদুল কালাম: এক চিরকালীন স্বপ্নদ্রষ্টা

তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার। যেখান থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা শত কোটি আলোকবর্ষ দূরের কল্পনাতেও কেউ ভাবে না। কারণ যেখানে সরকারি কর্মকর্তা হওয়াও আশ্চর্যের ব্যাপার। 
এ পি জে আবদুল কালাম।

তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার। যেখান থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা শত কোটি আলোকবর্ষ দূরের কল্পনাতেও কেউ ভাবে না। কারণ যেখানে সরকারি কর্মকর্তা হওয়াও আশ্চর্যের ব্যাপার। 
প্রত্যন্ত সেই গ্রামে তার পরিবার ছিল আরো দরিদ্র। রামেশ্বরম ও ধনুষ্কোডির মধ্যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নৌকায় পারাপার করাতেন তার বাবা। এক বেলা আধপেটা হয়ে দিন চলতো তাদের। সকালে কাজ করে স্কুলে যেতেন, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ফের নৌকায় জুটতেন। কিন্তু এতোকিছুর পরও পড়াশোনায় ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কাজ শুরু করতে হয়েছিল আবদুল কালামকে। কলেজে ভর্তির পর তাকে পত্রিকায় লেখালেখির কাজও শুরু করতে হয়েছিল।

তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমের প্রত্যন্ত গ্রামে এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। ছবি: সংগৃহীত

তার আত্মজীবনীতে তিনি বলেছিলেন ছোটবেলার কথা। 'যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার মা আমাদের জন্য রান্না করতেন। তিনি সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করার পর রাতের খাবার তৈরি করতেন। এক রাতে তিনি বাবাকে এক প্লেট সবজি আর একেবারে পুড়ে যাওয়া রুটি খেতে দিলেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম বাবার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু বাবা চুপচাপ রুটিটা খেয়ে নিলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন স্কুলে আমার আজকের দিনটা কেমন গেছে। আমার মনে নেই বাবাকে সেদিন আমি কী উত্তর দিয়েছিলাম কিন্তু এটা মনে আছে যে, মা পোড়া রুটি খেতে দেয়ার জন্য বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এর উত্তরে বাবা মা'কে যা বলেছিলেন সেটা আমি কোনদিন ভুলবো না। বাবা বললেন, 'প্রিয়তমা, পোড়া রুটিই আমার পছন্দ'। পরবর্তীতে সেদিন রাতে আমি যখন বাবাকে শুভরাত্রি বলে চুমু খেতে গিয়েছিলাম তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তিনি কি আসলেই পোড়া রুটিটা পছন্দ করেছিলেন কিনা। বাবা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'তোমার মা আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং তিনি অনেক ক্লান্ত ছিলেন। তাছাড়া একটা পোড়া রুটি খেয়ে মানুষ কষ্ট পায় না বরং মানুষ কষ্ট পায় কর্কশ ও নিষ্ঠুর কথায়।' 
নিজের মায়ের সম্পর্কে আরেকটি লেখায় এপিজে আবদুল কালাম লিখেছিলেন, 'আমাদের বাড়িতে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বলতো, সেই আলোতে আমরা পড়তাম। তবে মা আমার পড়ার আগ্রহ দেখে আমাকে শোয়ার ঘরের কেরোসিনের বাতি দিতেন যেন আমি অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত পড়তে পারি। এখনো পূর্ণিমা দেখলে আমার মায়ের মুখটাই সর্বপ্রথম যেন দেখতে পাই।
মায়ের সঙ্গে এ পি জে আবদুল কালাম। ছবি: সংগৃহীত
 
আরেক লেখায় এপিজে আবদুল কালাম লিখেছিলেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কথা। প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে অঙ্ক কষতে চলে যেতাম শিক্ষকের কাছে। সেই শিক্ষক পাঁচ জনকে অঙ্ক শেখাতেন তার মধ্যে আমি ছিলাম। দেড় ঘণ্টা অঙ্ক কষে সকাল সাড়ে পাঁচটায় ছুটি পেয়ে তিন কিলো দৌড়ে যেতাম কেবল দৈনিক পত্রিকা আনতে। যুদ্ধের কারণে স্টেশনে ট্রেন থামতো না, আর তাই চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলা সেই পত্রিকা আমি বিলি করতাম সারা শহরে।' 
এপিজে আবদুল কালামের পছন্দের বিষয় ছিল পদার্থবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্র। তবে অধ্যয়ন শেষে আব্দুল কালামের কাছে আসে দুইটি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ। একটি বিমান বাহিনীতে এবং আরেকটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তবে আব্দুল কালামের স্বপ্ন ছিল মিলিটারি বেইজের একজন ফাইটার পাইলট হওয়া। লিখেছিলেন আত্মজীবনীতে 'বছরের পর বছর ধরে আমি স্বপ্ন দেখতাম একটি উড়ন্ত যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের স্তরে চষে বেড়াচ্ছি যা উড়তে থাকবে সেই উচ্চ সীমানায়।' নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে তিনি এভাবে লেখেছিলেন। তাই তিনি প্রথমে ডিটিডিপি'র ইন্টারভিউ দিয়ে যান দেরাদুন বিমান বাহিনীর ইন্টারভিউ দিতে। তিনি দেখলেন ইন্টারভিউতে বিমানবাহিনীতে শিক্ষা এবং দক্ষতার পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দেয়। তিনি ছিলেন অনেকটা হ্যাংলা পাতলা। ফলে ৯ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ৮ জনই নির্বাচিত হয় শুধুমাত্র তিনি বাদে।
বাদ পড়ার খবরটা পাওয়ার পর তিনি একটি নদীর ধারে চলে গেলেন। সেখানে এক সাধু তাকে নদীর পাড়ে বসে থাকতে দেখে বললো, খোকা তুমি নদীর পাড়ে বসে আছ কেন? তোমার মন খারাপ? উত্তরে তিনি বললেন, আমার জীবনের কোনো অর্থ নেই। আমি পাইলট হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি। এই জীবনের কোনো অর্থ পাচ্ছি না। সাধু হেসে বললেন, 'বাবা তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছো। এটারও কোনো অর্থ আছে। ভাগ্য হয়তো তোমাকে অন্য কিছুর জন্য তৈরি করেছে। খুঁজে দেখো, এই পথ তোমার জন্য নয়।' 
এরপর তিনি বিমান প্রযুক্তি বিষয়ে পড়লেন। মজার বিষয় হলো সে যে প্রথমে পদার্থবিদ্যা পড়েছিলেন সে চার বছরকে জীবনের সময় নষ্ট হয়েছে বলে মনে করতেন তিনি।
ভারতের প্রখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. বিক্রম সারাভাইয়ের সঙ্গে এ পি জে আবদুল কালাম। তখন তিনি তার অধীনে কাজ করছেন। ছবি: সংগৃহীত

একসময় তিনি ভারতের অসামরিক মহাকাশ কর্মসূচি ও সামরিক সুসংহত নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ভারতের মহাকাশ যাত্রার সূচনাকারী বলা হয় তাকে। অন্যদিকে তার অবদানের জন্য তাকে বিশ্বজুড়ে ডাকা হয় 'মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া'। 
জীবনে বারবার হেরেছেন কিন্তু জিতেছেন তার পরেরবারই। কোট টাই পরাও ধরেছেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর। দুর্নীতি যার পিছু আসলেও টলাতে পারেনি একবিন্দুর জন্য। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে তিনি যেদিন বের হয়েছিলেন সেদিন তার সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত কাপড়চোপড় আর বই। 
আবদুল কালামকে নিয়ে তার সাবেক সচিব অবসরপ্রাপ্ত আইএএস কর্মকর্তা পি এম নায়ারের একটি সাক্ষাৎকার দূরদর্শনের তামিলভাষী আঞ্চলিক চ্যানেল ডিডিপোধিগাই প্রচার করেছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'এ পি জে আবদুল কালাম যখনই বিদেশ যেতেন, তখনই দামি উপঢৌকন নিতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। এর কারণ, এটাই রাষ্ট্রাচার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ও জাতিরাষ্ট্রের কাছ থেকে সফররত বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের এ ধরনের উপঢৌকন নেওয়া একটি বৈশ্বিক প্রথা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। এই উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করা হলে তা কোনো জাতির প্রতি একটা উপহাস এবং ভারতের জন্য তা বিব্রতকর। সুতরাং, তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে এসব উপঢৌকন নিতেন। কিন্তু তিনি ফিরে আসার পরে তার নির্দেশ থাকতো, সব উপহারসামগ্রীর আলোকচিত্র তুলতে হবে। এর ক্যাটালগ করতে হবে। এরপর তা রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে দিতে হবে। এরপরে তাকে আর কখনও উপহারসামগ্রীর দিকে ফিরে তাকাতেও দেখা যায়নি। তিনি যখন রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করেছিলেন, তাকে এমনকি একটি পেনসিলও নিয়ে যেতে দেখা যায়নি।'

যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এ পি জে আবদুল কালাম।

২০০২ সালে এ পি জে আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতির পদ নিয়েছিলেন, তখন রমজান মাস। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্য এটা একটা নিয়মিত রেওয়াজ যে তিনি একটি ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন। একদিন আবদুল কালাম তার সচিব পি এম নায়রাকে বললেন, 'কেন তিনি একটি পার্টির আয়োজন করবেন? কারণ, এমন পার্টির অতিথিরা সর্বদা ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। তিনি পিএম নায়ারের কাছে জানতে চাইলেন, একটি ইফতার পার্টির আয়োজনে কত খরচ পড়ে?' পি এম নায়ার তাকে বললেন, 'প্রায় ২২ লাখ রুপি খরচ হয়।' এপিজে আবদুল কালাম তাকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, 'কয়েকটা নির্দিষ্ট এতিমখানায় এই অর্থ, খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে দান করতে হবে।'
রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম এতিমখানা বাছাইয়ের দায়িত্ব পেয়েছিল। মজার বিষয় হলো এ ক্ষেত্রে এ পি জে আবদুল কালাম কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। এতিমখানা বাছাইয়ের পরে এ পি জে আবদুল কালাম পিএম নায়ারকে তার কক্ষে ডেকে তার হাতে এক লাখ রুপির একটি চেক দিয়ে বললেন, তিনি তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে কিছু অর্থ দান করছেন। কিন্তু এ তথ্য কারও কাছে প্রকাশ করা যাবে না। 
পিএম নায়ার বলেছিলেন, আমি এতোটাই অবাক হয়েছিলাম যে আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, 'স্যার, আমি এখনই বাইরে যাব এবং সবাইকে বলব। কারণ, মানুষের জানা উচিত, এখানে এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যে অর্থ তার খরচ করা উচিত, শুধু সেটাই তিনি দান করেননি, তিনি সেই সঙ্গে নিজের অর্থও বিলিয়েছেন।'
এ পি জে আবদুল কালাম কখনোই জি হুজুর, ইয়েস স্যার ধরনের লোক পছন্দ করতেন না। একবার যখন ভারতের প্রধান বিচারপতি তার সঙ্গে সাক্ষাতে এলেন এবং কোনো একটি পর্যায়ে এ পি জে আবদুল কালাম তার সচিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আপনি কি আমার এ কথার সঙ্গে একমত?' পিএম নায়ার ভাবলেশহীনভাবে বললেন, 'না স্যার, আমি আপনার সঙ্গে একমত নই।' অবাক হয়ে গেলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একজন সিভিল সার্ভেন্টের পক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিমত করা এবং এতোটা প্রকাশ্যে করা, তা ভাবাও যায়নি। পিএম নায়ার প্রধান বিচারপতিকে বলেন, রাষ্ট্রপতি পরে তাকে প্রশ্ন করবেন, জানতে চাইবেন, কেন তিনি তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এবং যদি পিএম নায়ারের যুক্তি ৯৯ শতাংশ সংগত হয়, তাহলে তিনি তার মন পরিবর্তন করবেন। 
এ পি জে আবদুল কালাম কতোটা সৎ ছিলেন তা অবর্ণনীয়। একটা ঘটনার কথা বলি। একবার এ পি জে আবদুল কালাম কালাম তার আত্মীয়দের দিল্লিতে তার কাছে বেড়ানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারা সবাই রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকবেন এটাই নিয়ম । তো তার স্বজনেরা দিল্লি শহর ঘুরে দেখবেন। যা স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রীয় খরচেই হয়। কারণ রাষ্ট্রপতির অতিথিদের জন্য সবসময় গাড়ি বরাদ্দ থাকে। কিন্তু তার ধার ধারলেন না এ পি জে আবদুল কালাম। বাস ভাড়া করা হলো তাদের জন্য। সে খরচ নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন তিনি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এ পি জে আবদুল কালামের নির্দেশে তার আত্মীয় স্বজনদের থাকা-খাওয়ার খরচের হিসেবও করতে হয়েছিল। যার হিসেব দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ রুপির বেশি। যা সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। ভারতীয় ইতিহাসে আর কোনো রাষ্ট্রপতি এমনটি করেননি। 
এখানেই শেষ নয়। এ পি জে আবদুল কালাম একবার চাইলেন তার সঙ্গে তার বড় ভাই পুরো এক সপ্তাহ যাতে সময় কাটান। তাই হলো। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরে তার রুমভাড়া বাবদ তিনি অর্থ পরিশোধ করতে চাইলেন। কল্পনা করুন, একটি দেশের রাষ্ট্রপতি এমন একটি কক্ষের জন্য ভাড়া পরিশোধ করতে চাইছেন, যা তার নিজের জন্যই বরাদ্দ। এবারে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা পূরণ হলো না। কারণ, তার ব্যক্তিগত স্টাফরা ভেবেছিলেন, এতোখানি সততা অনুসরণ তাদের পক্ষে বিদ্যমান বিধির আওতায় সামাল দেওয়া কঠিন।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে এলে রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন এ পি জে আবদুল কালাম। তখন সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার সঙ্গে দেখা করে বিদায়ী শ্রদ্ধা জানান। পিএম নায়ার তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বিদায়ী অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। এ পি জে আবদুল কালাম জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কেন আপনার স্ত্রীকে আনেননি?' পিএম নায়ার বললেন, 'স্যার আমার স্ত্রী পা ভেঙেছে এক্সিডেন্টে। তাই ওকে আনতে পারিনি।' 
পিএম নায়ার বললেন, পরদিন সকালে আমি দেখি আমার ঘরের চারপাশে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী ছেয়ে ফেলেছে। নিরাপত্তারক্ষীদের জিজ্ঞাসা করতেই তারা বললো, রাষ্ট্রপতি আপনার বাড়িতে আসছেন। রাষ্ট্রপতি ঘরে ঢুকে পিএম নায়ারের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। এরপর চলে গেলেন। আপনি ভেবে দেখুন তবে কোন দেশের প্রেসিডেন্ট একজন সিভিল সার্ভেন্টের ঘরে এভাবে যাবেন না। কেবল তিনি এ পি জে আবদুল কালাম বলেই এসেছেন।' 
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে এ পি জে আবদুল কালামের পক্ষে নাকি সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সম্মতি দেয়া। তার কোমল হৃদয়ের দেখা মিলে সে ভাষ্যে।  তিনি লিখেছিলেন 'রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সম্মতি দেওয়া। আমি মনে করি পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে মানুষ অপরাধ করে। অপরাধের জন্য দায়ী সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে আমরা শাস্তি দিতে পারি না। শাস্তি দিই ব্যবস্থার শিকার মানুষদের।' 
যে বিজেপি শাসনামলে তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেই বিজেপির অন্যায়ের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের সরকারকে সরিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি শাসন সংক্রান্ত বিল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 
কখনোই কাজ থেকে ছুটি নেননি এ পি জে আবদুল কালাম। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পূর্ণ করার পর সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চষে বেড়িয়েছেন শিশু কিশোর তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্বুব্ধ করার কাজে, স্বপ্ন দেখিয়েছেন বারে বারে। 
শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন চিরকালীন অনুপ্রেরণার সঙ্গী।

এ পি জে আবদুল কালাম নিজে যেমন স্বপ্ন দেখেছেন আজীবন, স্বপ্নের পিছু ছুটেছেন ঠিক তেমনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রজন্মকে। বলতেন 'স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখে যেতে হবে। স্বপ্ন না দেখলে কাজ করা যায় না।' মাঝে মাঝে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলতেন, 'কখনো যদি নিজেকে একা মনে হয় তবে আকাশের দিকে তাকাবে। আমরা একা নই। পৃথিবীটা আমাদের বন্ধু। যারা কাজ করে ও স্বপ্ন দেখে প্রকৃতিও তাদের সাহায্য করে।' 
আজীবন লোভ করেননি অর্থের, জনপ্রিয়তার পিছু হাঁটেননি। চলেছেন নিজের স্বপ্নের পথে। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ তিনি যেন স্বপ্নমানবের মতো হেঁটে গেছেন। বারবার স্মরণ করে বলতেন, 'আমরা যদি উন্নত ও নিরাপদ ভারত রেখে যেতে পারি তাহলেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের স্মরণ করবে।' 
এ পি জে আবদুল কালামের ছোট ভাই কাসিম মোহাম্মদ তামিলনাড়ুতে একটি ছাতা মেরামতের দোকান চালান। এ পি জে আবদুল কালামের জানাজায় ও তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পিএম নায়ার গিয়েছিলেন তামিলনাড়ুতে। তিনি কাসিম মোহাম্মদের পা ধরে বললেন, 'এটি আপনার ভাইয়ের জন্য আমার শ্রদ্ধা। যে পরিবারে তার জন্ম, সে পরিবারে তার সহোদরের পদস্পর্শ করা আমার জন্য পরম ভাগ্যের বিষয়। 
এ পি জে আবদুল কালাম নিজে দারুণ কবিতা লিখতেন, সঙ্গীতের প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। কবিতা লেখা নিয়ে তিনি বলেছিলেন তার আত্মকথায়, 'গভীর দুঃখে কিংবা প্রচণ্ড আনন্দেই মানুষ কেবল কবিতা লেখে।' 
তার লেখা, তার ভাষ্যে অনুলিখনে লেখা উইংস অব ফায়ার, ইগনাইটেড মাইন্ডস, ইনডমিটেবেল স্পিরিট, ইউ আর বর্ন টু ব্লোসম, ফোর্জ ইউর ফিউচার, টার্ণিং পয়েন্টের মতো বইগুলো পড়লে বোঝা যায় কতোটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েও মানুষ চাইলে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে গিয়েও কী করে গভীরতর নিষ্ঠা আর দায়িত্ববোধে মগ্ন থেকে ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। এ পি জে আবদুল কালাম বারেবারে যেন হাতেকলমে শেখান অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, শ্রম, দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধ থাকলে মানুষ জয় করতে পারে অসাধ্যকেও।  
আর তাই নিজের মৃত্যুদিনের কথা ভেবে তিনি লিখেছিলেন, 'আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা করবেন না। যদি আমাকে ভালোবেসে থাকেন তবে সেদিন মন দিয়ে কাজ করবেন।' কিন্তু সেই শোক কি আর বাঁধা মানে সে অপেক্ষায়! 
আজ ভারতরত্ন জয়ী ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, লেখক, বিজ্ঞানী, স্বপ্নমানব আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালামের প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাকে। 
তথ্যসূত্র- 
উইংস অব ফায়ার/ এ পি জে আবদুল কালাম 
The boy from Rameswaram who became President/ Sumita Vaid Dixit 
Inauguration of memorial of former president of India Dr Apj Abdul Kalam by hon'ble prime minister/ Doordarshan Podhigai

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

8h ago