বুয়েটের অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনলাইনে স্নাতক পর্যায়ের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ইতোমধ্যে অনলাইনে পরীক্ষা পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়।
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনলাইনে স্নাতক পর্যায়ের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ইতোমধ্যে অনলাইনে পরীক্ষা পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার খাতা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দৃশ্যমান রেখে পরীক্ষার্থীকে সবসময় পরীক্ষায় ব্যবহৃত একটি ডিভাইসের (ডেস্কটপ/ল্যাপটপ/আইপ্যাড/স্মার্ট মোবাইল ফোন) ক্যামেরা চালু রেখে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি পরীক্ষা চলাকালীন প্রশ্নপত্র দেখা বা স্ক্যান করা অথবা উত্তরপত্র আপলোড করার জন্য প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে একটি অতিরিক্ত ডিভাইস (ডেস্কটপ/ল্যাপটপ/আইপ্যাড/স্মার্ট মোবাইল ফোন) সবসময় সঙ্গে রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, দুটি ডিভাইস দিয়ে যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, দুটি ডিভাইস চালু রাখার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হয় স্মার্টফোন অথবা কম্পিউটার। অনেকেরই দুটি ডিভাইস কেনার সামর্থ্য নেই। এগুলোর ব্যবস্থা করতে গিয়েও অনেককে ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনলাইনে অনুষ্ঠিত টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা এবং 'কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট' মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের লেটার গ্রেড দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের ফলাফল বা গ্রেড নির্ধারণকালে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ৭০ শতাংশ নম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহাল থাকবে।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেড়-দুই মাস আগে যখন ফাইনাল পরীক্ষার বিষয়ে কথা হচ্ছিল, তখন আমাদের দাবি ছিল অফলাইনে পরীক্ষা দেবো। আবাসিক শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়ে গেলে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হবে, এমন আশ্বাসও আমরা স্যারদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষকরা জানালেন অনলাইনেই টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা হবে। টার্ম ফাইনাল একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, এটাতে ৭০ শতাংশ নম্বরের ওপর গ্রেডিং হয়, আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে।'
প্রায় এক মাস আগে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অসুবিধা ও সমস্যা নিয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা একটি জরিপ করেন।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, 'আমরা নিজেরা যে জরিপ করেছিলাম, সেখানে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। আমরা সেটা শিক্ষকদের দিয়ে বলেছিলাম, এখানে সব বিস্তারিত আছে, সব স্টুডেন্ট আইডি, তাদের অবস্থান সবকিছু। তাদের সমস্যাগুলো আপনারা বিবেচনা করুন।'
শিক্ষার্থীদের করা সেই জরিপের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই লোডশেডিং সমস্যা ও ইন্টারনেটের সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'যারা গ্রামে আছে তাদের বাসায় প্রায়ই লোডশেডিং হয়। ইন্টারনেটের সমস্যা তো আছেই। ঝড় বৃষ্টির কারণে কারও কারও বাসায় দুই-তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ থাকে না। গত পরীক্ষার সময়েও আমরা দেখেছি অনেকেই বাসা থেকে বাইরে গিয়ে, দোকানে বসে, এমনকি ইউনিয়ন অফিসে বসে পরীক্ষা দিয়েছেন।'
গতবারের অনলাইন পরীক্ষার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে চতুর্থ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'গতবারের পরীক্ষা আনগ্রেডেড ছিল, যেখানে ৩০ শতাংশ নম্বর। তবুও আমাদের সাবমিশনের সময় ৩০ মিনিট দেওয়া হয়েছিল। অথচ টার্ম ফাইনালের পরীক্ষায় সাবমিশনের সময় দেওয়া হয়েছে ১৫ মিনিট। টার্ম ফাইনালে একেকজন শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ পৃষ্ঠা লিখতে হয়। এতোগুলো পাতা ছবি তুলে স্ক্যান করে আপলোড করতেও তো সময় লাগে।'
এ প্রসঙ্গে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, 'গতবারেরটা আনগ্রেডেড পরীক্ষা ছিল। অনেক শিক্ষার্থীই ভোগান্তি সহ্য করে পরীক্ষা দিয়েছে। অনেকে ফেলও করেছে।'
নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালীন কোনো শিক্ষার্থীর প্রক্টরাল ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা কোনো শিক্ষার্থী প্রক্টরাল ক্যামেরার দৃশ্যমান এলাকার বাইরে গেলে, তা পরীক্ষার তদারককারীরা তাৎক্ষণিকভাবে রেকর্ড করে রাখবেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, রেকর্ড করে রেখে পরীক্ষায় নম্বর কাটা হবে কি না, জবাবদিহি করতে বলা হবে কি না, এগুলোর কিছুই নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।
চতুর্থ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এখন রংপুরে বাড়িতে আছি। আমার বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ অন্য অনেকের তুলনায় ভালো। তবুও আগের পরীক্ষার সময় দুই দিন পরীক্ষার মাঝখানে আমার নেট চলে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার এক বন্ধুর বাড়ি রাঙামাটিতে। গত পরীক্ষায় সেও অনেক ভোগান্তির মধ্যে পড়েছিল। পরীক্ষার মাঝখানে তার ইন্টারনেট চলে যায়। শেষমেশ বহু কষ্টে দুই ঘণ্টা পর সে উত্তরপত্র জমা দিতে পেরেছিল। সেসময় শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে সেটি বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন এ ধরনের সমস্যাগুলো কর্তৃপক্ষ আমলেই নিচ্ছে না। দুটি ডিভাইসে ক্যামেরা অন রেখে দুই ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়া তাদের পক্ষেই সম্ভব, যাদের লোডশেডিং কিংবা ইন্টারনেটের সমস্যা নেই। অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের যে বাস্তবতা, সেটা কর্তৃপক্ষ যেন মানতেই চাইছে না।'
এ ছাড়া, পরীক্ষা চলাকালীন কোনো শিক্ষার্থী কোভিডে আক্রান্ত হলে কী হবে? পরীক্ষা নীতিমালার কোথাও সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি বুয়েট কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, 'সাধারণত আমরা যা দেখে আসছি, যদি কেউ পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয় তখন সে টার্ম উইথ-ড্র করে। সেক্ষেত্রে যেসব ল্যাব শেষ হয়েছে সেগুলোর নম্বর থাকে, আর টার্ম পরীক্ষা সে পরে দেয়। এখন এ বিষয়গুলোর কী হবে? কেউ যদি পরীক্ষার মাঝখানে কোভিডে আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে কি সে টার্ম উইথ-ড্র করতে পারবে? এই বিষয়গুলো কোথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়নি।'
সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই শিক্ষার্থীদের অনেককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লিখলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, 'শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে যে জরিপ বিশ্ববিদ্যালয়ের করার কথা ছিল, সেটা আমরা করেছি। আমরা যখন সার্ভে নিয়ে শিক্ষকদের দিই, নিজেদের দাবি জানাই, তখন আমাদের একটা বড় অংশকে শোকজ করা হয়েছে, ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে। এরপরই আমাদের একটা বড় অংশ দমে যায়। আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না, কারণ আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।'
বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. মিজানুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে। 

এক শিক্ষার্থীকে পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়েছে, 'আপনি...একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছেন এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের একই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য মানসিক চাপ ও প্ররোচিত করছেন। আপনার এ ধরনের কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলার পরিপন্থী।'
এই সংবাদদাতার সঙ্গে কথা বলার সময় বহিষ্কারের আশঙ্কার কথা জানিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই তাদের পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনলাইনেই পরীক্ষা হোক। তবে, সেটা বাস্তবসম্মত প্রক্রিয়ায় হতে হবে। দুই ঘণ্টায় ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না। পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টাই রাখা হোক এবং খাতা সাবমিট করার জন্য যৌক্তিকভাবেই সময় আরও বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। 
এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমরা ৩০ মিনিট সময় বরাদ্দ চাই। কারণ অনেক সময়ই দেখা গেছে, খাতা সাবমিট করতে গিয়ে বিভিন্ন ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। খাতা সাবমিট করার প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা হোক।'
তিনি আরও বলেন, 'কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের একটাই অনুরোধ। আপনারা আমাদের দিকটা বিবেচনা করে পরীক্ষা নীতিমালা নির্ধারণ করুন। টার্ম ফাইনাল একজন শিক্ষার্থীর জন্য বড় বিষয়। যার ইন্টারনেট ভালো, যার দামি ডিভাইসে ভালো ছবি ওঠে শুধু তার কথা বিবেচনা করে নীতিমালা নির্ধারণ খুবই দায়সারা একটি সিদ্ধান্ত।'
এ বিষয়ে জানতে বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারের ফোনে গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং আজ সোমবার দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ ছাড়া, তার ফোনে প্রশ্ন উল্লেখসহ টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি।
বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গেও কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে, তিনিও ফোন ধরেননি। এছাড়াও কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।

Comments

The Daily Star  | English
pharmaceutical industry of Bangladesh

Starting from nowhere, pharma sector becomes a lifesaver

The year 1982 was a watershed in the history of the pharmaceutical industry of Bangladesh as the government stepped in to lay the foundation for its stellar growth in the subsequent decades.

18h ago