কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার না করায় চট্টগ্রামে মশা কমছে না

কীটনাশকের কম কার্যকারিতা ও প্রয়োগে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা এবং প্রয়োগকারীদের কিছু অদক্ষতার কারণে মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পাচ্ছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
কীটনাশকের কার্যকারিতা যাচাইয়ে ফগিং করছেন গবেষক দল। ছবি: গবেষক দলের সদস্য

কীটনাশকের কম কার্যকারিতা ও প্রয়োগে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা এবং প্রয়োগকারীদের কিছু অদক্ষতার কারণে মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পাচ্ছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।

চসিক মশক নিধনের জন্য কার্যকর ওষুধ নিশ্চিত করণে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ছয় জন শিক্ষকের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়।

বিশেষজ্ঞ এই দল গতমাসের ৫ জুলাই তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং গত মঙ্গলবার তাদের গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়।

গবেষণায় দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের বর্তমানে ব্যবহৃত দুটি কীটনাশকের মধ্যে লার্ভি সাইডের কার্যকারিতা ১৬ শতাংশ আর অ্যাডাল্টি সাইডের কার্যকারিতা ফগিংয়ের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ এবং স্প্রে করলে এর কার্যকারিতা ৩৪ শতাংশ।

চসিকের সূত্র মতে, ২০২০ সালের মে মাসে প্রতি লিটার ৯৯০ টাকা দরে ১০ হাজার লিটার লার্ভি সাইড এবং ৪৮৫ টাকা লিটার দরে ১০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টি সাইড কেনা হয়। ক্রয়ের বিষয়টি দেকভাল করেন প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী।

তবে গতকাল বুধবার একটি দোকানে ক্রেতা সেজে যোগাযোগ করা হলে চসিকের কেনা প্রতি লিটার লার্ভি সাইডের দাম ৮০০ টাকা এবং অ্যাডাল্টি সাউডের দাম ৪০০ টাকা চাওয়া হয়।

কীটনাশকের কার্যকারিতা যাচাইয়ে মশার লার্ভা সংগ্রহ করছেন গবেষক দল। ছবি: গবেষক দলের সদস্য

গবেষক দলের সদস্য চবির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এইচ এম আবদুল্লাহ আল মাসুদ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চসিক থেকে মশক নিধনের জন্য কার্যকর ওষুধ নিশ্চিতে আমাদেরকে পাঁচটি কীটনাশকের নমুনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে বর্তমানে তারা দুটি ব্যবহার করছে এবং বাকী তিনটি পরীক্ষার জন্য আনা হয়েছে তবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।'

তিনি বলেন, 'আমরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছি চসিকের ব্যবহৃত দুটি কীটনাশকের মধ্যে লার্ভি সাইড প্রয়োগের দুই ঘণ্টা পর ১৬ শতাংশ মশার লার্ভা মারা যায়। অন্যদিকে অ্যাডাল্টি সাইড প্রয়োগের দুই ঘণ্টা পর ফগিংয়ের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ এবং স্প্রে করলে ৩৪ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া যায়।'

'নতুন তিনটির মধ্যে আমরা একটির স্প্রের ক্ষেত্রে শতভাগ কার্যকারিতা পেয়েছি। তবে এটি কেরোসিন সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করে প্রয়োগ করতে হবে। কেরোসিনেরও নিজস্ব কিছু কার্যকারিতা আছে। শুধু কেরোসিন ব্যবহার করলেই কিছু লার্ভা মারা যায়। তবে এটি ফগিং করলে মাত্র ১৪ শতাংশ কার্যকর,' তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা সিটি করপোরেশনের ৯৯ টি জায়গা পরিদর্শন করে ৫১ টি জায়গা থেকে লার্ভা সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে ৩৩ টি জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ১৫ টিতে প্রায় শতভাগই এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ৩৯টি জায়গায় অ্যানোফিলিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।'

আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, 'ফগিং করার একটি নিয়ম আছে। সাধারণত সন্ধ্যার সময় যখন মশা খাবারের খোঁজে বের হয় তখন ফগিং করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় দুপুরে, বিকেলেও ফগিং করা হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ায় ফগিং না করায় মশা মরে না।'

'যেসব জায়গায় জলাবদ্ধতা বেশি, পানির প্রবাহ কম সেসব জায়গায় মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে,' তিনি যোগ করেন।

গবেষক দলের সদস্য সচিব ও চবির উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চসিক যে দুটি কীটনাশক ব্যবহার করছে সে দুটি প্রস্তুতকারী কোম্পানির সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দিলে লার্ভা মরার হার ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত দেখা গেছে।'

ল্যাবে নেটের মধ্যে মশক নিধনের কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছেন গবেষক দল। ছবি: গবেষক দলের সদস্য

'তবে মাত্রা বাড়িয়ে ব্যবহার করলে মানুষের ক্যান্সার, হাপানি, চর্মরোগসহ নানা রোগ হতে পারে। তাছাড়া পরিবেশের জন্যেও অনেক বেশি ক্ষতি হবে,' তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা জালের ভিতরে মশা রেখে ফগিং ও স্প্রে করেও তা মরেনি। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের ফগিংয়ের সময় মশা উড়তে থাকে। কাজেই সেই সময়ে মশা আসলে মারা যায় কিনা সেটি নিয়ে এক ধরনের প্রশ্ন থেকেই যায়।' 

'যারা দীর্ঘদিন ধরে ফগিং করেন তারাও আমাদের জানিয়েছে ফগিংয়ে আসলে খুব বেশি মশা মরে না। তাছাড়া দীর্ঘদিন একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করায় মশাগুলো কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে যেতে পারে। এর জন্য কীটনাশক এবং মশার জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা দরকার,' তিনি যোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গবেষক দলের এক সদস্য বলেন, 'যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন তাদের দক্ষতার অভাব আছে। কীভাবে কীটনাশক মেশাতে হবে, কোথায় কোথায় তা প্রয়োগ করতে হবে, অনুপাত কী হবে ইত্যাদি বিষয়ে অনেকে জানেন না। এর ফলে অনেক সময় মশা মরে না।'

এই বিষয়ে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ শফিকুল মান্নান সিদ্দিকীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি গবেষণার ফলাফল অস্বীকার করে বলেন, 'আমরা যে দুটি কীটনাশকের ব্যবহার করছি সে দুটি ঠিক আছে। এই ফলাফল অন্য কীটনাশকের।'

লার্ভি সাইড ও অ্যাডাল্টি সাইড কী দামে কেনা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তার সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

পরবর্তীতে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি গবেষণার ফলাফলের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, 'গবেষকদের ফলাফলের পর আমরা ইতোমধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি শুরু করেছি। আমরা আগে যে কীটনাশক ব্যবহার করতাম তা এখন আর করব না।'

কর্মীদের অদক্ষতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কিছু কর্মী অদক্ষ থাকতে পারে তবে সেই সংখ্যাটি বেশি না। সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ হবে। তাছাড়া আমাদের অন্যান্য সদস্যরাও সবকিছু মনিটরিং করেন। গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা সবদিকে কাজ করছি।'

কীটনাশকের দাম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি তখন দায়িত্বে ছিলাম না। তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না।'

চবির গবেষক দলে অন্য সদস্যরা হলেন—রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তাপসী ঘোষ রায়, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। গবেষক দলের আহ্বায়ক ছিলেন প্রাণ রসায়ন এবং অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।

গবেষণার সহযোগিতা করেন চবির শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন, খন্দকার রাজিউর রহমান,সজীব রুদ্র, আরিফ হোসাইন, সনাতন চন্দ্র বর্মন, ইকরামুল হাসান, জয় দে, ওমর ফারুক এবং চবির সাবেক শিক্ষার্থী মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আশেকুল ইসলাম।

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Column by Mahfuz Anam: Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

12h ago