মুক্তিযুদ্ধ

৬ আগস্ট ১৯৭১: বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শিল্পী, সাহিত্যিকদের গণবিবৃতি

১৯৭১ সালের ৬ আগস্ট সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকার ফ্রন্ট পেজ ও সংবাদের কপি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক 'জয় বাংলা' পত্রিকায় প্রকাশিত 'নিলামের সম্পত্তি কিনছে কারা' শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'পাকিস্তানের জঙ্গি সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান এবং "দি পিপল" পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবিদুর রহমানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করেছেন। পাকিস্তানের জঙ্গি সরকার মনে হয় এদের গ্রেপ্তার করতে না পেরে কোনো এক বিশেষ জন্তুর মতো একেবারে পাগল হয়ে গেছে। ভাবটা এই- "তাদের না পাই, কিন্তু তাদের ঘরবাড়ি জমিজমা তো আছে। তারা তো পালিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় গভর্নর টিক্কা খানকে আমাদের জিজ্ঞাসা-এই সব সম্পত্তি কে কিনছে এবং কার এমন বুকের পাটা? বিশ্ববাসীর কাছে কাছে আজ এটা অজানা নয় যে পঁচিশে মার্চের পর গত চার মাসের মধ্যে পট পরিবর্তন হয়েছে। হানাদার পাক দস্যুরা আজ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আজ বাংলাদেশের বহু এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। এই অবস্থায় এমন কোন বাপের ব্যাটা আছে যে সাহস করে এইসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কিনবে।'

ঢাকায় এদিন

৬ আগস্ট কাইয়ুম মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুরের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে পিডিপির পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সাংবাদিকদের বলেন, 'ভারতের মিথ্যাচার ও ঘৃণ্য অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও রাজনীতিবিদেরা দক্ষ হাতে যেভাবে এখনও পরিচালনা করছে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উচিৎ নিরাপদ বোধ করা। দেশপ্রেমিক মুজাহিদ বাহিনী ও রাজাকারেরা এখন দক্ষ হাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে তা প্রশংসনীয়।'

৬ই আগস্ট ঢাকায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নূরুল আমিনের সঙ্গে দেখা করেন সিলেটের শান্তি কমিটির নেতা মকবুর আলী চৌধুরী, শাহাবুদ্দিনসহ পাঁচ সদস্যের একটি দল। এ সময় তারা দলের নানা কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

দেশব্যাপী এদিন

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম এদিন কুষ্টিয়ায় শান্তি কমিটির নতুন কমিটির সঙ্গে দেখা করেন। এদিন পুনর্গঠিত শান্তি কমিটির সভায় গোলাম আজম বলেন, 'জামায়াত কর্মীদের একই সঙ্গে রাজাকার, শান্তি কমিটি ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। ভারতের চর মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।'

৬ আগস্ট শায়খে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ শাখার প্রাক্তন সদস্য সচিব মওলানা আতাহার আলী এক বক্তব্যে বলেন, 'অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় রাজাকার ও মুজাহিদ কমিটিতে যোগ দেওয়ার বিকল্প নেই। পাকিস্তানকে আমরা প্রাণের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করবো। দেশদ্রোহী আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীর ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে নস্যাৎ করে দিব।'

ভারতে এদিন

৬ আগস্ট কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিত্র শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকারসহ বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য এক গণ বিবৃতি ও স্বাক্ষর প্রদান করেন। এই গণ বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, মনোজ বসু, সমরেশ বসু, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুবোধ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আবু সয়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুব, শান্তিদেব ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, কানন দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, পূর্ণেন্দু পত্রী, বিমল কর, শঙ্খ ঘোষ,  উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ।

বিবৃতিদাতা ও স্বাক্ষরদাতারা গণ বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের মুক্তির মুক্তি চেয়েছেন বলে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তায় পাকিস্তান সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে কারাগারে আটকে রেখেছে। অন্যদিকে তারাই পাকিস্তানে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছে। আমরা অতিসত্বর পাকিস্তান সরকারের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাই।'

৬ আগস্ট ভারতের লোকসভার অধিবেশনে ৫৪৫ সদস্যের মধ্যে প্রায় ৪৫০ জন সদস্য জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে লেখা এক স্মারকলিপিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটকের কথা তুলে তাকে মুক্তির বিষয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তারা পূর্ব বাংলায় চলমান অস্থিরতা নিরসনে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা দেওয়ার অনুরোধ করেন। 

৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার মিত্র মুসলিম দেশগুলোকে পাঠানো এক চিঠিতে বলে, 'আসন্ন সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের কাবুলে অনুষ্ঠিত ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলনে যেন পাকিস্তানকে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানোর কোন সুযোগ না দেওয়া হয়।'

পাকিস্তানে এদিন

৬ আগস্ট ইসলামাবাদে জনৈক সরকারি মুখপাত্র বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বলেছেন,  যদি ভারত অযাচিতভাবে পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায়, তবে চীন পাকিস্তানকে সব ধরণের সহায়তা ও সমর্থন দেবে।'

৬ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রেসনোটে বলে, 'গত ২৮ জুনের বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছে, সেই ৮৮ জন স্বীয় পদে বলবৎ থাকবেন।' তাদের তালিকা এই প্রেসনোটে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া, এই প্রেসনোটে বলা হয় 'যারা নাশকতামূলক কার্যকলাপে যুক্ত ছিল তারা এমএনএ ও এমপি পদ থেকে চিরস্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৬ আগস্ট মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক বিচার বিভাগীয় উপপরিষদের চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন সিনেটে বলেন, 'পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেওয়ার কারণেই উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।' তিনি তার বক্তব্যে এদিন শরণার্থীদের সমস্যার প্রতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বাস্তবতাবর্জিত নীতি গ্রহণের জন্য নিক্সন প্রশাসনকে অভিযুক্ত করেন।

৬ আগস্ট ব্রিটেনে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী ও অধ্যাপক ড্রেপার সুইজারল্যান্ডের জেনোয়া থেকে লন্ডনে ফিরে এসে প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপি জঁ জিগলারের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, সাক্ষাৎ ও নানা বিষয়ে রেডক্রস ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাখ্যা দেন।

৬ আগস্ট লন্ডনে পিডিপির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো পাকিস্তানের নামে ক্রমাগত মিথ্যাচার ও গুজব ছড়িয়েই যাচ্ছে। তারা পাকিস্তানকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে পাকিস্তানের শান্তিপ্রিয় মানুষকে অপমান করেছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। দেশদ্রোহীরা পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাঁধা সৃষ্টি ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় অহেতুক হামলা করায় সেনাবাহিনী কিছুটা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিল। সেই কঠোর পদক্ষেপকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও ভারত অতিরঞ্জিত ও মিথ্যার সংমিশ্রণে গণহত্যা দাবি করে তীব্র মিথ্যাচার করছে।' এই সফরে মাহমুদ আলীর যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম সফর করার কথা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

৬ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবশালী বার্তা সংস্থা 'তাস' এদিন এক প্রতিবেদনে জানায়, 'দিল্লি যাচ্ছেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো।  যাত্রার বেশ কয়েকদিন আগে সফরসূচি ঠিক করা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব রাখা হয়েছে।' এদিন 'তাস' এ সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দিল্লি থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেন ৮ আগস্ট দিল্লি পৌঁছাবেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো। এই গোপনীয় সফরের বিষয়ে জানার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এর আগে, ৯ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফর নিয়েও আলোড়ন উঠেছিল। প্রথমে পাকিস্তান সরকার গোপন রেখে বলেছিল, উষ্ণ আবহাওয়ার দরুন অসুস্থ হওয়ায় কিসিঞ্জারকে অ্যাবোটাবাদের নাথিয়াগালিতে পাঠানো হয়েছে। যদিও ততক্ষণে তিনি চীনের পিকিংয়ে পৌঁছে যান।

৬ আগস্ট প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'সম্প্রতি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশন থেকে বাঙালি কর্মকর্তাদের পদত্যাগই বলে দেয় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বাভাবিক আছে বলে যে প্রচার চালিয়েছেন তা মিথ্যা।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৬ আগস্ট নরসিংদীর রায়পুরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী রেঞ্জার ও রাজাকারদের এল এম হাইস্কুল ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ অভিযানে নয় জন পাকিস্তানী রেঞ্জার হতাহত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

৬ আগস্ট ময়মনসিংহে ছাত্রনেতা হাশেম মামুদ ও সুবেদার মেজর জিয়াউল হকের নেতৃত্বে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর  বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণ করে। বান্দরকাটা বিওপি নামক এই যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৩০ সেনা নিহত হয় ও ৩৫ জন আহত হয়। এ সময়  মুক্তিবাহিনীর পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

তথ্যসূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকা, ৬ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৬ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার, ৭ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ৭ আগস্ট ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected] 

Comments

The Daily Star  | English

BNP says ‘no’ to constitutional reforms under interim govt

The BNP has said it will not support any constitutional reforms before the national election in February 2026, arguing that such changes must be made by the next parliament.

5h ago