২৩ আগস্ট ১৯৭১: টাইম ম্যাগাজিনে 'পাকিস্তানে মুজিবের গোপন বিচার'

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৩ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম 'টাইম ম্যাগাজিনে 'পাকিস্তানে মুজিবের গোপন বিচার' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'যদিও পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য মুজিবকে অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু তারপরও বলতে হবে শেখ মুজিব পাকিস্তানের পূর্ণ বিভক্তি চাননি। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা তখনই দিয়েছেন যখন দেশব্যাপী গণহত্যা ও রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী।' টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক ডেভিড গ্রিনওয়েকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম সংগঠক বলেন, আমাদের জনগণ এর উপযুক্ত জবাব দেবে। আমার দেয়া সংকেত ঠিকঠাকই ফলেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকের পাঁচ মাস পর সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
গ্রিনওয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে হামলার ঘটনা তুলে এনে বলেন, 'এটি প্রমাণ করে পূর্ব বাংলার মানুষ কতোটা ক্রুদ্ধ এই সিদ্ধান্তে।' প্রতিবেদনে বলা হয়, 'শেখ মুজিব গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনই পেয়েছেন যা ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত করে এবং তার ফলে তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। যা ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার ঘনিষ্ঠদের জন্য সতর্কবার্তা। অথচ তাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব দেয়া হয়নি। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগ হবে হবে তখন ১২০০ মাইল দূরে সত্ত্বেও শেখ মুজিব কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষেই আন্দোলন করেছিলেন। অথচ এখন তাকে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে।'
ঢাকায় এদিন
২৩ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সব সদস্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮ জন এমএনএ ও ৯৪ জন এমপিএ-র বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই সঙ্কট মুহূর্তে অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে তাদের দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। সরকার তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।'
দেশব্যাপী এদিন
২৩ আগস্ট নোয়াখালীর হাতিয়ার নলচিরা বাজার জামে মসজিদ এলাকার শান্তি কমিটির এক সভায় মাহমুদুর রহমানকে সভাপতি, সৈয়দ আহমদ খানকে সম্পাদক ও মৌলভী ছালেহউদ্দিনকে যুগ্ম সম্পাদক করে নলচিরা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
ভারতে এদিন
২৩ আগস্ট ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএম) এর রাজনৈতিক শাখা থেকে এক বিবৃতিতে বলে, পূর্ব বাংলার আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে চীন যেভাবে সাহায্য করছে তা একটি জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আছে নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার। কী হবে না হবে তা তারাই বেছে নেবে। এদিন বেঙ্গালুরুতে সিপিএমের বিবৃতি শেষে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরিয়া বলেন, 'পূর্ব বাংলার মানুষের সিদ্ধান্তের ওপর যে ধরনের আঘাত করছে চীন তা নৈতিকতা তো বটেই মানবতাবিধ্বংসীও। চীনের এই ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।'
২৩ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে ও শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, কীভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা যায় সবকিছু নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলাপ চলছে। আমরা আশা করছি একটি সুষ্ঠু সমাধানে আমরা পৌঁছাতে পারবো। অন্যদিকে আমরা যদি নাও তুলি অন্য কোনো দেশ নিশ্চয়ই এই প্রস্তাবগুলো তুলবে।'
২৩ আগস্ট 'বাংলাদেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যে সংগ্রাম তা হলো সর্বাত্মক মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশানুসারে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। জনসাধারণকে বলা হচ্ছে, আপনারা সামরিক সরকারকে কোনো প্রকার ট্যাক্স দেবেন না। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদ বর্জন করুন। আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, মনে রাখবেন আপনার সক্রিয় সহযোগিতা আমাদের বিজয়কে আরও নিকটবর্তী করে তুলবে।'
পাকিস্তানে এদিন
২৩ আগস্ট লাহোরে পূর্ব পাকিস্থান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চরদের প্রধান শিকার জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরোধীতা করার জন্য সেখানে বহু জামায়াত কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। একমাত্র জামায়াত ইসলামী প্রদেশের প্রতিটি অংশে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করছে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৩ আগস্ট লন্ডনে পিডিপি নেতা মাহমুদ আলী বলেন, 'আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলছি, পত্র-পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে পরিস্থিতি ঠিক তার বিপরীত। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে সব প্রশ্ন তুলেছেন তা ঠিক নয়। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনে দেশের বহু উন্নতি হয়েছে। মিল, কলকারখানা, ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান বাঙালী অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রেও বাঙালীরা উচ্চ পদে রয়েছে। অথচ তারা প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার করেই যাচ্ছে।'
২৩ আগস্ট লন্ডনে ব্রিটেনে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও মানবাধিকার ক্ষুণ্ণের বিষয়টি তুলে ধরে মানবাধিকার কমিশনের জরুরি সভা ডাকতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে অনুরোধ জানিয়ে একটি তার বার্তা পাঠান। এসময় তিনি বলেন 'ইয়াহিয়া খানের অবৈধ সরকার যেভাবে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকে মানবাধিকার কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপনে সামরিক আদালতের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে অথচ তাকে বিচারের মুখোমুখি করার অধিকার পাকিস্তানের থাকতে পারে না।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
২৩ আগস্ট প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম নিউজ উইকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো গত সপ্তাহে নয়াদিল্লি গেলেন, ভারতের কূটনৈতিক গোষ্ঠী বলতে গেলে খেয়ালই করেনি। কিছু ভিনদেশি দূতদের ভারতীয় কর্মকর্তাগণ আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে আঁদ্রে গ্রোমিকোর সফরে তেমন বিশেষ কিছু ফলতে যাচ্ছে না। তবে আগমনের একদিনের মধ্যেই আঁদ্রে গ্রোমিকো জানিয়েছেন যে তিনি ভারতের রাজধানীতে জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছেন। দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পতাকাখচিত টেবিলে বসে আঁদ্রে গ্রোমিকো সফল স্বাক্ষর করেন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার বিশ বছরের শান্তি, বন্ধুত্ব, ও সহযোগিতার এক চুক্তিতে। অথচ বাহ্যিকভাবে চুক্তির কথাগুলো এত স্থুল ছিল যে, এক পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে, এটি কার্যত যে কোনো কিছুই বোঝাতে পারে। তবে এই চুক্তির গুরুত্ব অল্পই নির্ভর করছে, কারণ এতে কী বলা হয়েছে বা এর দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে তার ওপর। আরেকটি পরাশক্তির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ভারত তার জোটবদ্ধ না হওয়ার নীতি থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। দৃঢ়ভাবে ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসে রাশিয়া পাকিস্তানকে যে কোনো বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়ার বিরুদ্ধে সাবধান করে দিলো। অবশ্য, এর মাধ্যমে মস্কো খোলামেলাভাবে চীনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করল এবং দক্ষিণ এশিয়াতে হঠাৎ করেই শক্তির ভারসাম্য বদলে দিলো। একই ধারাবাহিকতায়, এ চুক্তি এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হওয়ার প্রতিফলন। আর সেই অর্থে, ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি পিকিং আর ওয়াশিংটনের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্কে আজ অব্দি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিপর্যয় বলে গণ্য করা যেতে পারে।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৩ আগস্ট ফেনীতে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পরশুরামের চিথলিয়াতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে হানাদাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা আহত অবস্থায় পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
২৩ আগস্ট চাঁপানবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কানসাট অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে চার ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ভয়াবহ এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয় ও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
২৩ আগস্ট কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জগন্নাথদিঘি ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময়ে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চারটি বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয় এবং বহু হানাদার সেনা নিহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদেই নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
২৩ আগস্ট কুমিল্লায় হানাদার বাহিনীর সেনাদের একটি নৌকা সেনেরবাজারের পাশ দিয়ে চলতে থাকলে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের নৌকার ওপর গুলিবর্ষণ করে। এসময় ৭ হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৩ আগস্ট কুমিল্লায় ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গলের 'এ' ও 'সি' কোম্পানি হানাদার সেনাদের নয়ানপুর রেলস্টেশন অবস্থানের ওপর উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কয়েকটি শক্ত বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয় এবং অনেক হানাদার সেনা নিহত হয়।
সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
টাইম ম্যাগাজিন ২৩ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৪ আগস্ট ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments