কোথাও যাওয়ার নেই

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও তালেবানদের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় বিশ্লেষকেরা বলছেন সারা বিশ্বের নজর সরে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফাইল ছবি

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও তালেবানদের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় বিশ্লেষকেরা বলছেন সারা বিশ্বের নজর সরে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

সেনাদের নির্মম অত্যাচার থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে থাকে। তারা জানান, মিয়ানমারে কোনো বৈধ সরকারের অস্তিত্ব নেই এবং তাদের নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেখানে ফিরে যাওয়া আগের তুলনায় এখন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশে ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সমন্বয়কারী খিন মাউং বলেন, 'আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। মিয়ানমার আমাদের মাতৃভূমি। কিন্তু সেখানে কোনো বৈধ সরকার নেই। কারা আমাদের নিরাপত্তা দেবে, আবারও যদি আমরা নির্যাতনের শিকার হই সেই দায়িত্ব কে নেবে?

অং সাং সুচি'র এনএলডি পার্টির সরকারকে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি উৎখাত করার পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে। এই সামরিক ক্যু'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় এক হাজারের বেশি বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যার জন্য তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে তারা।

অন্যদিকে এনএলডি পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে সামরিক জান্তাবিরোধী একটি ছায়া সরকার গঠন করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী- যেমন কারেন, কাচিন, মোন, কারেন্নি, চিন, কায়ান সম্প্রদায়ের নেতারা এনইউজির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছেন। এছাড়াও সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরুর উদ্দেশ্যে তারা 'পিপলস ডিফেন্স ফোর্স' (পিডিএফ) গঠন করেন।

মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এনইউজি এখনও দেশটির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কিংবা জাতীয় ঐক্য সরকার, কোনোটিই এখনও বৈধতা পায়নি, যে বিষয়টি রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমেন রাইটস এর সভাপতি মহিব উল্লাহ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বলেন, 'মিয়ানমারের সরকার এখন বিভাজিত। কোন সরকার বৈধ, এ ব্যাপারে অক্টোবরে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আছে। এই মুহূর্তে বিষয়টি ঘোলাটে।'

প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে অনিশ্চয়তা নতুন কিছু নয়। ২০১৭ সালে সহিংসতা থেকে বাঁচতে ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, তারা আগেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার সাথে যুক্ত হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে। এছাড়াও মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপি'র সঙ্গে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই করে।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) কোনো বৈঠক ২০১৯ সালের মে মাসের পর অনুষ্ঠিত হয়নি, যদিও এই উদ্যোগের আওতায় বছরে দুটি করে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমার বৈঠক আয়োজন করতে না পারার পেছনে কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারির কথা বলেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দলের পর থেকে এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।

এমন কী চীনের নেতৃত্বে ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে একাধিক বৈঠক হলেও সেখান থেকে কোনো ফল আসেনি। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্টে নেওয়া প্রত্যাবর্তনের দুটি উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) গত বছরের জানুয়ারিতে জারি করা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশটিও কোনো অগ্রগতি এনে দিতে পারেনি।

নজর এখন মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও আফগানিস্তানের সংকটের ওপর

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তারা বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে পশ্চিমের শক্তিদের নজর রোহিঙ্গা সংকট থেকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে সরে গেছে।

এখন চীন, রাশিয়া ও ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্ব আফগানিস্তান সংকট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যেটি প্রতিদিন নতুন রূপ ধারণ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ১৫ আগস্ট তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে নেওয়াতে ভয়াবহ পর্যায়ের অস্থিতিশীলতা ও শরণার্থী সংকট তৈরি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, 'মিয়ানমারে সামরিক ক্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো সামরিক শাসক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেনি। অপরদিকে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে, যেটি মিয়ানমারকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছে'

তিনি জানান, মিয়ানমারের সামরিক শাসকের ওপর প্রভাব পড়বে যদি পশ্চিমা শক্তিগুলো সেখান থেকে আমদানি করা বন্ধ করে, অথবা জাপান, ভারত ও আসিয়ান তাদের ওপর চাপ দেয়। তবে এরকম হওয়ার সম্ভাবনা এ মুহূর্তে নেই বললেই চলে, জানান তিনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এনইউজি এক বক্তব্যে জানিয়েছে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। তারা গণহত্যার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার করেছে। তাদের এই মনোভাব বাংলাদেশের চাওয়ার সঙ্গে মিলে যায়।

বিশ্লেষকরা জানান, সামরিক ক্যুর শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের জনগণের কিছুটা সহানুভূতি ছিল। তবে এই বিষয়টি এনইউজি'র নেতৃত্বে গণতন্ত্রের পুনপ্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভরশীল।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকও জানান, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে খুব একটা উৎসাহী নয়, তবে তারা জানিয়েছে পূর্বের সরকারের আমলে সাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর প্রতি সম্মান জানানো হবে।

সামনে কী আসছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে আগের সব রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ঘটনাগুলো সামরিক শাসনামলে ঘটেছে। এখন আবারও সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আছে এবং তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনা করা সহজ হবে, কারণ তারা এ বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে আছে।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও একই সুরে কথা বলেছিলেন। 

তবে কর্মকর্তারা জানান, এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে কোনো কার্যকর যোগাযোগ হয়নি।

হুমায়ুন কবির ও মো. শহীদুল হক বলেন, তাত্ত্বিকভাবে এটি সঠিক হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। এনইউজি সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়াতে সামরিক শাসকদের মূল লক্ষ্য এখন তাদের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত ও সমন্বিত করা, রোহিঙ্গা সংকটে নজর দেওয়া নয়।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) সিনিয়র ফেলো মো শহীদুল হক জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এখন অনেকটাই মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের ওপর নির্ভরশীল।

সুতরাং বাংলাদেশের এখন এনইউজি'র সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়টিকে বিবেচনা করা উচিত, কারণ তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  

তিনি বলেন, 'আমাদের সব বাধা বিপত্তি জয় করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে মিয়ানমারের সামরিক শাসকসহ সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।'

হুমায়ুন কবির জানান, যদিও আসিয়ান আগে এ বিষয়ে তেমন কোনো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেনি, তারা এখন সংকট নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

তিনি জানান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো কিছু দেশ এই বিষয়টি নিয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠ এবং ঢাকার উচিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ় করা।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত ও জাপানের জাতীয় স্বার্থ জড়িয়ে আছে, তবুও তারা নিজ দেশের স্বার্থকে রোহিঙ্গা সংকট থেকে আলাদা রাখলে সেটি আমাদের কাজে আসতে পারে।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে তাদের উচিত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করতে অনুরোধ জানানো।'

অধ্যাপক ইমতিয়াজ জানান, বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠ এখন পর্যন্ত খুব একটা শক্তিশালী নয়। সারা বিশ্বের রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব ও ঐক্য তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

তিনি জানান, 'পরিশেষে, সমস্যাটি রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের মধ্যে। আমাদের উচিত তাদের আলোচনার সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা।'

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments