মুক্তিযুদ্ধ

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তি সংগ্রামের ৬ মাস উপলক্ষে ভাষণ দেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধারা এখন সর্বত্র বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে আগামীতেও হবে। বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য। ইতিমধ্যেই মুক্তিবাহিনীর বহরে বিমান, জাহাজ যুক্ত করা হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান এম এ জি ওসমানী তার বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সফলতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীতে প্রতিনিয়তই বহু মুক্তিযোদ্ধা নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন, সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের পর্যদুস্ত করে ফেলেছে।

ঢাকায় এদিন

২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা টাইম বোমায় নেজামে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাদেশিক সরকারের মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন মন্ত্রী মওলানা মোহাম্মদ ইসহাক আহত হন। লালবাগে সভা শেষে সচিবালয়ে যাওয়ার পথে ঢাকা মেডিকেলের সামনে গাড়িটি পৌঁছালে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। ড্রাইভারের আসনের নিচে বোমাটি পাতা হয়েছিল।

জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আজম জামায়াতে ইসলামী থেকে মনোনীত দুজন মন্ত্রী আব্বাস আলী খান এবং এ কে এম ইউসুফের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন ' মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে আমরা বাঙালী জাতীয়তাবাদ মানতে রাজি নই। জামায়াতের কর্মীরা পাকিস্তান অখণ্ড রাখার সংগ্রামে নিজেদের আত্মাহুতি দিচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশের জন্য যত শহীদ হয়েছে তার প্রায় সবাই জামায়াত কর্মী।

পাকিস্তানে এদিন

২৫ সেপ্টেম্বর করাচিতে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র এক ঘোষণায় বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে ভারতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সামনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার জন্য পাকিস্তানের যেসব প্রতিনিধি বিদেশ সফর করছেন তাদের মধ্যে দৈনিক 'ইত্তেফাক'-এর সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ রয়েছেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৫ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের সঙ্গে দেখা করেছেন। এসময় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শেখ মুজিবের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তার আশঙ্কার কথা জানান।

২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব উ' থান্টের কাছে এক পত্রে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ বলেন, 'পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ করছে। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, জাতিসংঘের কতিপয় সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘ বিধির প্রতি সমর্থনের বুলি আউড়িয়ে প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মূলনীতিকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত থেকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন করে তুলেছে।'

দেশব্যাপী এদিন

২৫ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ২৮টি ঘটনার তথ্য পেশ করবে। ১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনাবলির তথ্য তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে সরকার।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৫ সেপ্টেম্বর গালিমপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শেষ পর্যন্ত পিছু হটে ফিরে যায়। এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ২ নম্বর সেক্টরে এমএল পয়েন্টার নামের একটি লঞ্চে নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে গালিমপুরের কাছে এলে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। সারারাত ধরে চলা এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে হানাদার সেনারা পিছু হটে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন জাফর আলী খান, সুবেদার আবদুল্লাসহ ৪৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং লঞ্চটি ডুবে যায়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম এবং মুহম্মদ আলী শহীদ হন।

২৫ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার নারায়ণপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল লুটপাট শেষ করে ক্যাম্পে ফেরার পথে পায়েলগাছায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুললে ১৩ হানাদার সৈন্য ও ১৬ রাজাকার নিহত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৫ গেরিলা শহীদ হন।

২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ছাতকের টেবলাই গ্রামে অবস্থানরত এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধার ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি দল ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে মেলা সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর বাঁশতলা পর্যন্ত পিছিয়ে যান। পরে বাঁশতলা থেকে বিপুল পরিমাণ মুক্তিযোদ্ধা গোলাবারুদ নিয়ে ফিরে এসে তীব্র আক্রমণ গড়ে তুললে হানাদার বাহিনী পিছু হটে। প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বহু সৈন্য আহত হয়। অন্যদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

২৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনী ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালায়। এই দুঃসাহসিক অপারেশনে ১৭ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ৯ জন আহত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনী ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশন ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে এদিন ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি আক্রমণে ৮৫ জন হানাদার পুলিশ ও রাজাকার নিহত হয়।

২৫ সেপ্টেম্বর ফেনীর পরশুরামের গুথুমা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ১৫ সদস্যের একটি গেরিলা দল হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ৩ হানাদার সেনা হতাহত হয়।

২৫ সেপ্টেম্বর ১ নম্বর সেক্টরের চম্পকনগরে মুক্তিবাহিনী রকেট লঞ্চারের সাহায্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চম্পকনগর বিওপির উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি বাঙ্কার বিধ্বস্ত হয় এবং ৫ সৈন্য নিহত হয়।

২৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ফেনীর পরশুরাম ও অনন্তপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এর আগে গত কয়েকদিন ধরে সালদা নদীর হানাদারদের অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনী গেরিলা ও আর্টিলারি হামলা চালিয়েছিল। 

২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের দিয়াতলিতে হানাদার বাহিনীর সেনারা অভিযান থেকে ফিরে আসার সময় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তাদের উপর হামলা চালায়। এসময় একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক ইত্তেফাক ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Leather legacy fades

As the sun dipped below the horizon on Eid-ul-Azha, the narrow rural roads of Kalidasgati stirred with life. Mini-trucks and auto-vans rolled into the village, laden with the pungent, freshly flayed cowhides of the day’s ritual sacrifices.

18h ago