ধূপখোলা মাঠ: এই ‘উন্নয়ন’ কার জন্য?

ঢাকা শহর থেকে ধীরে ধীরে খেলার মাঠ হারিয়ে যেতে থাকলেও, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার ধূপখোলা মাঠ এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
স্টার ফাইল ফটো

ঢাকা শহর থেকে ধীরে ধীরে খেলার মাঠ হারিয়ে যেতে থাকলেও, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার ধূপখোলা মাঠ এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।

এই মাঠ শুধু সব বয়সী মানুষের খেলার জায়গাই না, আশেপাশের এলাকার সব মানুষের ঘোরাঘুরি ও বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যও সেখানে যান। বছরের পর বছর ধরে মাঠটি এলাকার ঐতিহ্য ও গর্বের একটি অংশ হয়ে উঠেছে।    

তবে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ধুপখোলা মাঠের ভেতরে একটি মার্কেট তৈরির কাজ শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, এটি মাঠ 'উন্নয়ন' উদ্যোগের অংশ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মার্কেট তৈরির পরিকল্পনা মাঠের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করবে। খেলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে না।

৭ দশমিক ৪৭ একরের মাঠটির ৩টি ভাগ আছে। জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) মাঠ, ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব খেলার মাঠ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত একটি মাঠ। তিনটি অংশের প্রত্যেকটি আকারে একটি ফুটবল মাঠের চেয়ে বড়।

ডিএসসিসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাঠের চারপাশজুড়ে থাকা ৩৯৪টি দোকানকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ একটি ৫ তলা মার্কেট নির্মাণ করবে। এ মার্কেটের কারণে মাঠের মোট ০ দশমিক ৬২ শতাংশ জায়গা কমে যাবে।

এ ছাড়া, সিটি করপোরেশন হাঁটার রাস্তা, বসার ব্যবস্থা, পার্কিং স্পেস ও একটি ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ করতে যাচ্ছে। পাশাপাশি, মাঠে শিশুদের জন্য একটি আলাদা জোন থাকবে। ফলে মাঠের জায়গা আরও কমবে। 

প্রকল্পের নথি অনুসারে, শিশুদের জোনের জন্য শূন্য দশমিক ৬ একর জায়গা লাগবে। অবশ্য, অন্য উদ্যোগগুলোর জন্য কতটুকু জায়গা লাগবে তা নথিতে উল্লেখ নেই। জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে চায়নি।

নথিতে অবশ্য বলা হয়েছে, 'উন্নয়ন' কাজের পরে ফুটবল মাঠের আকার ৭ দশমিক ৪৭ একর থেকে ৪ দশমিক ০১ একরে নেমে আসবে। এর ফলে মাঠের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোই হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ধূপখোলা মাঠ ঐতিহাসিক কারণে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি অনেকেরই উদ্বিগ্ন হওয়ার অন্যতম কারণ।

ধূপখোলা ক্রিকেট একাডেমির কোচ মো. ইয়াকুব জানান, এ মাঠে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মার্শাল আইয়ুব ও মোহাম্মদ জাকির হোসেনসহ জাতীয় পর্যায়ের অনেক ক্রিকেট খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

তিনি জানান, তারা ও বুলবুল ডিএসসিসির এ কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু, ডিএসসিসি তাতে কান দেয়নি।

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ রফিকও ধুপখোলা মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া, আতাউর ও মামুন বাবুর মতো জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলাররাও সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এখনো প্রতি বছরই ধূপখোলা মাঠ থেকে জাতীয় খেলোয়াড় তৈরি হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১ হাজারেরও বেশি শিশু ও তরুণ ওই মাঠে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলেন। ৩টি ক্রিকেট এবং ২টি ফুটবল একাডেমিও রয়েছে সেখানে।

গেন্ডারিয়া ক্রিকেট একাডেমির প্রধান রেজাউল ইসলাম বলেন, '৩টি ক্রিকেট একাডেমির অধীনে এখানে প্রায় ৫০০ ক্রিকেটার নিয়মিত অনুশীলন করেন।'

ধূপখোলা ক্রিকেট একাডেমির কোচ মো. ইয়াকুব জানান, মাঠে ৮০ এর দশকে রোপণ করা অনেক পুরনো গাছও রয়েছে। উন্নয়ন কাজের সময় এগুলো কাটা পড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'মাঠের ১ ইঞ্চি জমিও নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, মেগাসিটিতে খেলার মাঠ এমনিতেই দুষ্প্রাপ্য।'

তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের মাঠগুলো জনসাধারণের চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করে।

তিনি বলেন, 'হাঁটার রাস্তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, এই উদ্দেশ্যে মাঠের জমি ব্যবহার করলে মাঠ ছোট হয়ে যাবে এবং এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে যাবে।'

এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল জানান, তাদের শিক্ষার্থীরা ১৯৮২ সাল থেকে মাঠটি ব্যবহার করে আসছে।

তিনি বলেন, 'আমরা মেয়রের সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা মাঠটি ব্যবহার করতে পারব বলে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।'

কামাল বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ক্যাম্পাস না পাওয়া পর্যন্ত যেন তারা মাঠটি ব্যবহার করতে পারেন, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিএসসিসিকে চিঠি দিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে ধূপখোলা মাঠ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মুন্সী মো. আবুল হাশেম বলেন, 'মাঠের কিছু অংশ মার্কেট, হাঁটার রাস্তা ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু, মাঠের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা নেওয়া হবে- এ কথা ঠিক নয়।' 

তিনি বলেন, 'সবাই সেখানে খেলার সুযোগ পাবে। কেউ বঞ্চিত হবে না।'

এসব স্থাপনা মাঠের বাইরে না করে কেন ভেতরে নির্মাণ করা হচ্ছে, জানতে চাইলে হাশেম স্থান স্বল্পতার দিকে ইঙ্গিত করেন।

প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্প উপদেষ্টা লিমিটেড।

প্রতিষ্ঠানটির আর্কিটেক্ট আতিকুর রাহমান আতিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'উন্নয়ন কাজ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। শেষ হতে এক বছর লাগবে।' 

আতিক জানান, তারা দোকানপাট সরিয়ে ৫ তলা মার্কেটে নিয়ে আসবেন। এটি হয়ে গেলে সিটি করপোরেশন খালি জায়গা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে। বসার ব্যবস্থাসহ একটি সবুজ জায়গা রাখার পরিকল্পনা আছে তাদের। 

তিনি আরও জানান, মার্কেটের বেজমেন্টে ৫৮টি এবং মাঠের কিছু নির্দিষ্ট স্থানে ৩১টি গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা থাকবে। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে শিশুদের প্লে-জোনের জন্য মোট ০ দশমিক ৬ একর জায়গা রাখা হবে।

আতিক দাবি করেন, তারা মাঠের তিনটি অংশকে একত্রিত করছেন। ফলে ধূপখোলা মাঠ আকারে আন্তর্জাতিক মাঠের চেয়েও বড় হবে।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

8h ago