অপরাধ ও বিচার

বহুরূপী প্রতারক!

কখনো ভূমি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কখনো জেলা প্রশাসকের অফিসের কর্মচারী আবার কখনো কখনো সরকারি দপ্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

কখনো ভূমি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কখনো জেলা প্রশাসকের অফিসের কর্মচারী আবার কখনো কখনো সরকারি দপ্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেন তিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর এলাকার আবুল কালাম আজাদ (৪৮) গত ৮ বছরে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য এ রকম অসংখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

এ সময়ে তিনি জমি সংক্রান্ত বিবাদ মেটানো ও চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। হাতিয়ে নেওয়া টাকার মাধ্যমে তিনি এখন দুটি ভবন, মোহাম্মদপুরে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ও একাধিক গাড়ির মালিক।

ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে বেশ কয়েকবার বিয়েও করেছেন তিনি। তার এক স্ত্রী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) উপ-পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।

আত্মসাৎ করা অর্থের অংশবিশেষ ব্যয় করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের জন্য নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন তিনি।

আজাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লাউর ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ব্যানারে ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আবারো এ বছর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থিতার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তবে এবার তিনি বিএনপির ব্যানারে প্রচারণা চালান।

রাষ্ট্রীয় সংস্থার নথি জাল করে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন আজাদ। হ্যাপি হোমস লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে।

মামলার তদন্ত করার সময় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট আজাদ ও তার ২ সহযোগী মোবারক ও নুর হোসেনকে ঢাকা থেকে গত বুধবারে গ্রেপ্তার করে।

সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি শুক্রবারে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আজাদের ৪ থেকে ৫ সদস্যের একটি দল আছে। আজাদ এই অপরাধচক্রের নেতা।

তৌহিদুল আরও জানান, আজাদ ও গ্রেপ্তারকৃত অন্যদের বিরুদ্ধে ৪ থেকে ৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

আজাদের প্রতারণার অন্যতম শিকার হ্যাপি হোমস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শরীফ হোসেন চৌধুরী জানান, তারা ঢাকার ২৫-২৭ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে ৫৪ কাঠা জমির ওপর একটি ভবন তৈরি করেন।

সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে একটি ক্ষতিপূরণের নোটিশ দেওয়া হয়। শরীফ তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়।

পরবর্তীতে হাইকোর্ট জমির জন্য ১৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তবে ১৩ বছর পার হয়ে গেলেও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাপ্য টাকা বুঝে পায়নি বলে অভিযোগ করে।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য দৃশ্যপটে আজাদের আবির্ভাব ঘটে।

অভিযোগকারী ও পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজাদ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেখা করে এবং সমস্যাটি সমাধান করে দেওয়ার জন্য ৮ কোটি টাকা দাবি করেন।

আজাদ ডেভেলপারদের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য ভুয়া পে অর্ডার, জাল চেক ও জেলা প্রশাসকের অফিসের জাল ছাড়পত্র দেখান।

অভিযোগ অনুযায়ী, আজাদ ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে ডেভেলপারের কাছ থেকে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি তাদের সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

অভিযোগকারী ও পুলিশ জানায়, প্রতিষ্ঠানটি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি তাদের হুমকি দিতেন।

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক জেরায় আজাদ ৯২ লাখ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, 'আমরা তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়েছি। আদালতে আগামী সপ্তাহে রিমান্ড শুনানি হবে। আমরা জেরার মাধ্যমে আজাদের কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।'

স্থানীয় ও পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আজাদ যানবাহনের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে নবীনগর থেকে ঢাকায় আসেন।

শুরুতে তিনি নীলক্ষেত থেকে নথি জাল করতেন এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন, জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

স্থানীয়রা দাবি করেন, তারা আজাদকে একজন ব্যবসায়ি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে চেনেন।

স্থানীয়রা আরও দাবি করেন, গত কয়েক বছরে আজাদ চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাদের সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ ছিন্ন করেন।

অভিযোগ এসেছে, আজাদ তার এলাকায় একটি জমি একাধিক মানুষের কাছে বিক্রি করেছেন। তিনি নথি জাল করার মাধ্যমে সবার কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন।

নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুর রশিদ জানান, আজাদের বিরুদ্ধে ৩টি প্রতারণা মামলা ও একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এই সংবাদদাতার সঙ্গে কথা বলেন লাউর ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল চৌধুরী। তিনি জানান, আজাদ অনেক মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তার চাচাতো ভাই আজাদকে ৬ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন।

নবীনগর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল ইসলাম জানান, আজাদ সাভারে একটি জমির ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন।

শরীফুল আরও বলেন, তিনি জনৈক মিজানের কাছ থেকে ৬ লাখ ও নবীনগরের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান নাজমুল করিমের কাছ থেকেও ১০ লাখ টাকা নেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Preparing for Ramadan's Price Shocks

Power price to go up 4 times a year

The government has drawn up a plan to increase the price of electricity four times a year for the next three years to withdraw all subsidies in the power sector, which the IMF recommends.

1h ago