আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী: ঝুমন দাশ

ঝুমন দাশ আপন বললেন, ‘মত প্রকাশ কোনো অপরাধ তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
ঝুমন দাশ আপন। ছবি: সংগৃহীত

ঝুমন দাশ আপন বললেন, 'মত প্রকাশ কোনো অপরাধ তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রায় সাড়ে ৬ মাস বিনা বিচারে ও বিনা জামিনে জেলে থাকার পর গত মঙ্গলবার জামিনে মুক্ত হয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথা বলেন তিনি।

গত ১৬ মার্চ আটক হওয়ার পর থেকে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। পাল্টে গেছে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের উপজেলা শাল্লা'র নোয়াগাঁওয়ের ২৫ বছর বয়সী এই যুবকের জীবন।

হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক মামুনুল হকের বক্তব্যের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট লেখার অপরাধে তাকে আটক করা হয়।

প্রথমে 'কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর'র ৫৪ ধারায় তাকে আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। আটকের ৬ দিন পর ২২ মার্চ শাল্লা থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল করিম বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

ঝুমন দাশ বলেন, 'আমি অবাক হয়েছি, একজন পুলিশ উপ-পরিদর্শক আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কিন্তু, পুলিশ আমার বিরুদ্ধে মামলা করায় এটি হয়ে গেলো আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মামলা।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি মানুষের ব্যক্তিগত মতামতে বিশ্বাস করি। আর তাই এটাও বুঝি যে কোনো ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হলেও তার ব্যক্তিগত মতামত অবশ্যই রাষ্ট্রের অভিমত না। রাষ্ট্রের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।'

ঝুমন দাশের আটকের পর থেকে তার জামিন আবেদন সুনামগঞ্জ আদালতে ৪ বার ও উচ্চ আদালতে ১ বার নাকচ হয়। সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত তাকে শর্তসাপেক্ষে ১ বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। শর্ত অনুযায়ী ঝুমন দাশ নিজ জেলা সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে চাইলে আদালতের অনুমতি লাগবে।

তার আটক হওয়ার সময়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'গত ১৫ মার্চ দিরাইয়ে (শাল্লা'র পার্শ্ববর্তী উপজেলা) সমাবেশে মামুনুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে কটূক্তি করেন। আমি তার প্রতিবাদে মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিই।'

'সেদিনই জানতে পারি যে আমার এই লেখায় অসংখ্য হেফাজত সমর্থক বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারা যেন আমার নামে ও আমার প্রোফাইল ছবি দিয়ে অসংখ্য ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে আমি কখনোই যা লিখিনি তা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে সেটা শেয়ার করে স্থানীয়দের উস্কে দেন। আমার বন্ধুরা তখন পরামর্শ দেন যে আমি যেন পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।'

'তাদের পরামর্শে আমি রাজি হলে তারা পুলিশকে সংবাদ পাঠায়। সবার উপস্থিতিতে শাঁসখাই বাজারে আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করি। প্রথমে আমাকে শাল্লা থানায় ও পরে সেখান থেকে সুনামগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।'

'পরদিন জেলে থাকতেই সংবাদ পেলাম আমাদের গ্রামে অসংখ্য মানুষ হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। এরপর যখন আমাকে আদালতে নেওয়া হয়, তখন জানতে পারলাম আমাকে পুলিশের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।'

গত ১৭ মার্চ, ঝুমনের আটকের একদিন পর, তার গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে হামলা চালায় হেফাজত সমর্থক কয়েক শ মানুষ। সেসময় ৯০টি বাড়ি ও ৪টি মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়।

ঝুমন বলেন, 'হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা জেলে এসে অন্য কয়েদিদের আমার বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং সবাইকে বলতে থাকেন আমি ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছি। বিষয়টি জেলে আমার নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখা দিলে জেল সুপার আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।'

'আটক হওয়ার কয়েকমাস আগে আমি বাবা হই। জেলে আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল আমার ছেলেকে না দেখা। আমার মাও সারাজীবন কষ্ট করে আমাদের ৬ ভাইবোনকে বড় করেছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি জেলে থাকায় তার কী কষ্ট হচ্ছে।'

ঝুমন দাশ তার অবর্তমানে যারা তার পরিবারের পাশে ছিলেন সবাইকে ধন্যবাদ ও যারা তার মুক্তির জন্যে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেন, 'গত প্রায় ১০ বছর ধরে আমি নানা কোম্পানির সেলসে কাজ করেছি সিলেট অঞ্চলে। ঢাকায়ও ছিলাম কয়েক দিন। সম্প্রতি, আমার ভাইদের সাহায্যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। কিন্তু, এখন সব শেষ। তার ওপর উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলার বাইরে যেতে আমাকে অনুমতি নিতে হবে। আমি জানি না কিভাবে নতুন করে সব শুরু করবো।'

নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে ঝুমন বলেন, 'আমার মুক্তির পর সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আমাকে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু, বলেছেন যে আমি যেখানেই যাই না কেন, তা পুলিশকে জানাতে হবে। এমনকি, গ্রামের বাইরে বাজারে গেলেও যেন অবশ্যই পুলিশকে জানাই যাতে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। আমি জানি না এভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে কিনা। আমি সবসময়ই ভয়ের মধ্যেই আছি।'

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ঝুমন দাশ বলেন, '২০১৩ সাল থেকে আমি ফেসবুক ব্যবহার করি। সাধারণত মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে লিখি। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। আমি কখনোই রাষ্ট্র বা ধর্মবিরোধী কিছু লিখিনি।'

'সেদিন আমি ব্যক্তি মামুনুল হকের সমালোচনা করেছিলাম। তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করায় দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত লেগেছে। আমার লেখা ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং ব্যক্তি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ছিল।'

Comments

The Daily Star  | English

Transport strike in Ctg: Passengers suffer amid heatwave

Sidratul Muntaha, a student, went to the port city's Natunpara bus stand area this morning in order to catch a bus to Chawkbazar, where she was scheduled to attend class at a coaching centre

1h ago