সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কী করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন?

বেশ কিছু দিন ধরে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কমিশনকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

বেশ কিছু দিন ধরে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কমিশনকে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

সম্প্রতি কমিশনের পক্ষ থেকে দেশের ৬৪টি জেলার ডেপুটি কমিশনারকে মানবাধিকার সংক্রান্ত জেলাভিত্তিক কমিটি গঠনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি জেলা পর্যায়ে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগসমূহ নিয়ে কাজ করবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটিগুলোর নেতৃত্ব দেবেন ডেপুটি কমিশনার, যেখানে সহসভাপতি হিসেবে থাকবেন পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন।

এ ছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন স্থানীয় প্রেসক্লাব, জেলা বার কাউন্সিল, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের স্থানীয় সমন্বয়ক। চিঠিতে কমিশনের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের দাপ্তরিক যোগাযোগের সুবিধার্থে সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের দপ্তরে অভিযোগ ও তদন্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন এমন একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে 'মানবাধিকার বিষয়ক ফোকাল ডেস্ক' হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

কমিশনের সচিব স্বাক্ষরিত এ চিঠির সূত্র ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে মানবাধিকার রক্ষায় কমিশন কাজ করতে আগ্রহী— এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কমিটি গঠনের মতো এমন ইতিবাচক প্রচেষ্টায় সরাসরি তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ থাকে সবচেয়ে বেশি।

অনেকেই তাই এ উদ্যোগকে কৌতুক করে বলছেন— এটা অনেকটা  'শেয়ালকে মুরগি পাহারায় রাখা' কিংবা 'ভেড়া পাহারায় নেকড়েকে রাখা'। সরকারি চাকুরে বা নির্বাহীরা এ কমিটির প্রধান বা সদস্য হিসেবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার বিধানের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখবেন। তাই নিজেদের বা সহকর্মীদের দায় মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ ধরনের উদ্যোগ আদৌ কমিশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করবে কি না তা বিবেচনার ক্ষেত্রে কমিশন দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে পারেনি বলে অনেক মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের মূল ভূমিকা কী হওয়া উচিত? দেশে দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে রাষ্ট্রের মানবাধিকার সংক্রান্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। রাষ্ট্র মানবাধিকার সংক্রান্ত স্বীকৃত মানদণ্ডগুলো মেনে চলছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করে, ব্যত্যয় ঘটলে রাষ্ট্রকে সঠিক পথ দেখায়, করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করে। আমাদের দেশেও একটি স্বতন্ত্র আইন দ্বারা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছে। যাকে মানবাধিকার প্রচার ও প্রসারে একটি বিস্তৃত এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।

আমাদের মতো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব বেশি না হলেও কমিশন থেকে এইটুকু প্রত্যাশা করা যায়, কমিশন তার নিজের এখতিয়ার অনুযায়ী মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষত রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেখানে ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। যা প্রায়শ দৃশ্যমান হচ্ছে না বলেই নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। কমিশন মানবাধিকার, অপরাধ সংগঠন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পার্থক্য কিংবা তাদের প্রতিষ্ঠা আইন— জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর আওতায় দেওয়া এখতিয়ার সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি কমিশন কীভাবে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের নাগরিক সংগঠনগুলো থেকে আলাদা করছে, তাও তাদের কার্যক্রমে ষ্পষ্ট হয়নি।

এর আগেও বর্তমান কমিশনের পক্ষ থেকে নানা সময়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য এসেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ দেখার জন্য সরকারের নিজস্ব বিভাগ রয়েছে কিংবা দেশে এ ধরনের অভিযোগ ছাড়াও অনেক মানবাধিকার ইস্যু রয়েছে। এ ছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকার বিধানে অন্যান্য নাগরিক সংগঠনগুলো যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে কমিশন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে, যেমন সংবাদ বিবৃতি প্রদান, প্যানেল আইনজীবী তৈরি, আইনের খসড়া প্রণয়ন ইত্যাদি। জেলাভিত্তিক কমিটি গঠনের সাম্প্রতিক উদ্যোগও এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কমিশন নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উন্মুক্ত বাছাই ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি, কমিশন গঠনে প্রাক্তণ আমলাদের প্রধান্য (যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে অবসর গ্রহণ করলেও সরাসরি মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না) ও বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশনের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা হতাশা তৈরি করেছে। গত কয়েক বছরে কমিশন কোনো গবেষণা কার্যক্রম বা জরিপ চালিয়েছে, বিভিন্ন আইন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখছে কি না সে বিষয়ে কোনো মতামত দিয়েছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে— তা লক্ষ করা যায় না বললেই চলে।

বর্তমান কমিশন প্রধান ও সদস্যরা দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাস পর করোনা মহামারির বিস্তার কমিশনের কাজে বাধা তৈরি করেছে। এরপরও এ সময়ে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ঘটেছে যার মধ্যে অন্যতম বাজেট বৃদ্ধি, বাড়তি জনবল নিয়োগ, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা দ্রুততর করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ। অন্যদিকে করোনাকালে মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কমিশনের বিভিন্ন চিঠি প্রেরণ, মানবাধিকারকর্মীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে নির্দেশিকার খসড়া প্রণয়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে প্রথম বারের মতো জাতীয় তদন্ত (ন্যাশনাল ইনকোয়ারি) পরিচালনার উদ্যোগ সবার কাছে ইতিবাচক বলে বিবেচিত হয়েছে।

আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যেটি কমিশন চলতি বছরের শুরুতে নিয়েছে— জাতীয় মানবাধিকার আইন ২০০৯ সংশোধনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে কমিশনের ব্যর্থতার জন্য এ আইনের ১৮ ধারাকে বারবার দায়ী করা হলেও তা সংশোধনের জন্য কমিশন আগে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে বিবেচনায় আইন সংশোধনের জন্য কমিশনের এ প্রস্তাবনা এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যেন তার ম্যান্ডেট সঠিকভাবে পূরণ করতে পারে এবং রাষ্ট্রের মানবাধিকার সংক্রান্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে তার জন্য কমিশনের ম্যান্ডেট সম্পর্কে কমিশন ও সরকার উভয় পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে। কেবলমাত্র একটি 'নখদন্তহীন বাঘ' হিসেবে কমিশন থেকে গেলে তা প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারের প্রসার ও রক্ষায় খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং তা দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্র ও সরকারের ইমেজ সংকট তৈরি করবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাই আইন সংশোধনের মাধ্যমে কমিশনের সদস্য বাছাই প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক করা, মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কমিশনে প্রাধান্য দেওয়া, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা প্রদান, কমিশনের অনুরোধের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও যথাযথ সাড়া প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা আবশ্যক।

কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন মেকানিজম ও দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া জরুরি। কমিশনের বর্তমানে ১২টি ইস্যুভিত্তিক কমিটি রয়েছে। এসব কমিটিকে কার্যকর করে তোলার পাশাপাশি কমিশন একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে পারে যাদের সঙ্গে সময়ে সময়ে কমিশন মত বিনিময় করতে পারে। কমিশনের ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার এবং বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ কমিটি ভূমিকা রাখতে পারে।

সামনের দিনগুলোতে বর্ধিত জনবল ও বাজেট নিয়ে মানবাধিকার রক্ষা ও প্রসারে কমিশন কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তার রূপরেখা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। কমিশন তার নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দেবে, সেটাই নাগরিকদের প্রত্যাশা।

তামান্না হক রীতি: সহকারী সমন্বয়ক, মিডিয়া অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Will there be any respite from inflation?

To many, especially salaried and fixed-income individuals, this means they will have no option but to find ways to cut expenditures to bear increased electricity bills.

5h ago