মুক্তিযুদ্ধ

৫ অক্টোবর ১৯৭১: বাংলাদেশ এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র: ফ্রেড ইভান্স

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৫ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের প্রভাবশালী এমপি ফ্রেড ইভান্স এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাংলাদেশ এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।'

তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও বাঁচার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই বাঙালি আজ হানাদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তারা আজ যে লড়াই করছে তা হলো দেশকে মুক্ত করার লড়াই- শত্রুমুক্তির লড়াই। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেরই এগিয়ে আসা উচিত। অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হলে এশিয়ার এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবে। অবিলম্বে এর সমাধান করতেই হবে। বাংলাদেশের মূল সমস্যা মানবিক চেতনা ও মানবাধিকারের সমস্যা।'

ঢাকায় এদিন

৫ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামের পাশে জিন্নাহ এভিনিউতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল হানাদার বাহিনীর একটি জিপে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ২ জন অফিসারসহ জিপটি বিধ্বস্ত হয়।

৫ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী মজলিসে সুরার তৃতীয় দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। এই বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপ-নির্বাচন পরিচালনার জন্য গোলাম আযমের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা হলেন নুরুজ্জামান, আব্দুল খালেক, গোলাম সারোয়ার ও শফিকুল্লাহ।

৫ অক্টোবর কাউন্সিল মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম শফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তান থেকে তারা পাকিস্তানের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করার জন্য কানাডাসহ পাশ্চাত্যের বেশ কয়েকটি দেশ সফর করবেন।

ভারতে এদিন

৫ অক্টোবর দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলে, পাকিস্তানকে আর কোনো ধরনের অস্ত্র বিক্রির লাইসেন্স নতুন করে দেয়া হয়নি।

৫ অক্টোবর ভারতের ত্রাণ ও শরণার্থী মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, 'পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখ ৯১ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন মোট ৮০০ ডাক্তার ও ২ হাজার নার্স শরণার্থী ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৫ অক্টোবর মার্কিন সিনেটে শরণার্থী বিষয়ক বিচার বিভাগীয় এক কমিটিতে শরণার্থীসংক্রান্ত উপকমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থী বিষয়ক বিতর্ক নিয়ে অভিযোগ করে বলেন, 'প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর সিনেটের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ৯০ লাখ ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি দিতে চেয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গত এপ্রিল মাসে প্রস্তাব করা হয়েছিল জুন মাসে পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করল। অথচ পাকিস্তান অস্ত্র ব্যবহার করছে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর। বিষয়টি সিনেটে বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো কার্যকারিতা আসেনি। অভিযোগের জবাবে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ভ্যান হেলেন বলেন, মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানকে কোনো ধরনের নতুন লাইসেন্স দেয়া হয়নি। আর যেসব অস্ত্রের চালান পাঠানো হয়েছিল তা আগেই অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। নতুন করে কোনো অস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দেয়া হয়নি।

৫ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় দেশটির সংসদের সামনে অনশন পালন করে দুই ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক ও এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। এসময় তারা অস্ট্রেলিয়া সরকারের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে শরণার্থীদের জন্য ১ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার পাঠানোর আহবান জানান।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৫ অক্টোবর কুমিল্লার বাঞ্ছারামের উজান চরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একটি দল বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ পাইলন কেটে নদীতে ফেলে দিয়ে ওঁত পেতে থাকে। বিদ্যুৎ পাইলনের খবরে কুমিল্লা থেকে হানাদার সেনা, মুজাহিদ ও রাজাকারেরা ৩/৪টি লঞ্চে করে আসে পাইলনগুলো সরাতে। এসময় ওঁত পেতে থাকা মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চগুলোর উপর আক্রমণ করে। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হন।

৫ অক্টোবর ময়মনসিংহের ভালুকায় বিরুলিয়া ও মেদিলা গ্রামে রাজাকারদের লুটতরাজ করবার খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকারদের উপর আক্রমণ করে। এসময় রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

৫ অক্টোবর কুমিল্লার উত্তরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের একটি দল আজলাপুর ও জামবাড়ি এলাকায় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটি টহলদার দলের উপর আক্রমণ করে। এ সময় হানাদার বাহিনীর ১৫ সৈন্য নিহত হয় এবং ২০ জন আহত হয়। অন্যদিকে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ১ জন আহত হন।

৫ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুমারসাইল চা বাগানে মুক্তিবাহিনীর ২০ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল অ্যামবুশ করে। এসময় হবানাদার বাহিনীর একটি দল অ্যামবুশের আওতায় এলে গেরিলা দলটির মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৫ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ৩ মাইল দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল একটি সেতু উড়িয়ে দেয়।

৫ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার নয়নপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় ৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান ৬ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ৬ অক্টোবর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

The price of unchecked protest politics

Under the guise of “mob justice,” various groups, including students, have taken the law into their own hands.

48m ago