হেলাল হাফিজের গোপন কলরব

হাজার বছরের বাঙালির জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কবিতা। আর বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা যে কবিতা তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিমিতিবোধের বিজয়ী কবি হেলাল হাফিজ সেই সমৃদ্ধ শাখায় বিজয় কেতন ঘোষণা করেন ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে।

হাজার বছরের বাঙালির জীবনাচরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কবিতা। আর বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা যে কবিতা তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিমিতিবোধের বিজয়ী কবি হেলাল হাফিজ সেই সমৃদ্ধ শাখায় বিজয় কেতন ঘোষণা করেন ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হেলাল হাফিজ 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতা নিয়ে বাংলা কবিতা ভুবনে প্রবেশ করলেন। কবিতাটি তখনকার কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস না পেলেও আহমদ ছফার মধ্যস্থতায় কবিতাটির প্রথম দুটি চরণ রাতারাতি ছেয়ে যায় ঢাকা শহরের দেয়াল। লাইন দুটি গণঅভ্যুত্থানকে যেন বারুদের মতো উসকে দেয়।

জনপ্রিয় হয়ে যান এই কবিতার স্রষ্টা। সিক্ত হতে থাকেন মানুষের ভালোবাসায়। খ্যাতিমান হয়েছেন 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' লিখে। এই কথাটি সত্য— হেলাল হাফিজের কবিতা নিয়ে পাঠকের কাছে জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' লেখা না হলে কি তার অন্যান্য কবিতা দিয়ে তিনি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারতেন না? আমি বলবো অবশ্যই পৌঁছাতেন।

কারণ 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' ছাড়া তার অন্যান্য কবিতাও বাংলা কবিতার ইতিহাসে কবির নামকে স্থায়ী করে রাখতে সমানভাবে পারঙ্গম। এক্ষেত্রে আমি কবির ১৯৮৩ সালে লেখা 'প্রস্থান' কবিতার কথা উল্লেখ করতে পারি—

আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,

নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে

পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি...

পাঁচ দুপুরের নির্জনতাকে কী অদ্ভুত এক শৈল্পিক অনুভূতি দিয়ে কবি হত্যা করেন, ক'জন পারেন এমনভাবে।

তার প্রথম কাব্যের প্রায় প্রতিটি কবিতা পাঠককে ছুঁয়ে যায় জীবনের নানা অনুষঙ্গে। একইভাবে আমরা তার 'নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল' কবিতার কথাও উল্লেখ করতে পারি। ছলনাহীন প্রেমের 'ফ্রয়েডীয়' দাবি হিসেবে কবি ৫টি আঙুলকে বিশুদ্ধতায় বাজানোর যে সুকৌশলী অ্যাপ্রোচ তা বাংলা কবিতায় অভিনব। এঁকেছেন শর্তহীন প্রেমের মানচিত্র, অনুরণিত হয় জৈবনিক আকাঙ্ক্ষা; তবে সব মিলিয়ে শৈল্পিক চিত্রপটে— নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায় অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়কাল থেকে মধ্য আশির দশকের স্বৈরশাসনের মাতাল হাওয়ায় লেখা ৫৬টি কবিতায় কবি অসাধারণ কারুময় শৈল্পিক সত্তা ও নান্দনিকতায় প্রেম, সমকাল ও স্বদেশের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রেমে বিগত ও বর্তমানের রূপচিত্র এঁকেছেন তা পাঠকের কাছে খুবই পরিচিত ও অর্থবহ। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে, এর পরপরই তিনি হয়ে যান নীরব।

১৯৬৯ থেকে ১৯৮৬ সালে— দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষা শেষে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার ১ম কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে'। এরপর কবিতার অঙ্গন থেকে বোধ হয় ঈশ্বরী পাটুনীর হাত ধরে নিজের কবিতাকে পাঠকের কাছে সমর্পন করে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন স্বেচ্ছায় নিকেতনহীন বেদনার এই রাজপুত্র। তবে, পালিয়ে যাননি। দূর থেকে দেখেছেন, আর কবিতার নব প্রায়োগিক দিক নিয়ে ভেবেছেন।

কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও পাঠকের প্রতি অসম্ভব সম্মান না থাকলে কোনো কবি এতটা সংযমী হতে পারেন না। তরুণ বয়সে খ্যাতির মোহ তাকে তার কাব্যবিশ্বাস থেকে টলাতে পারেনি। তিনি যখন মনে করেছেন বই প্রকাশ করা দরকার, ঠিক তখনই তা করলেন। বাংলা সাহিত্যে এই বিষয়টিও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বহু বছর।

হেলাল হাফিজ কম লিখলেও তিনি কবিতার সঙ্গে কম ছিলেন না। সব সময়ই তার কবি মানস সজাগ। পৈতৃক রক্তের দায়বদ্ধতা যার কবিতায় তিনি তো ফিরবেন। সুদীর্ঘ ৩৪ বছর পরে ফিরে আসলেন, এবং পিতৃদত্ত সেই রক্তের মহান দায়বদ্ধতার কথা পাঠকে স্মরণ করিয়ে 'পিতার পত্র' উপস্থাপন করে অনুরাগী পাঠকদের বোঝালেন কবিতা ও বেদনা যে তার উত্তরাধিকার— 'রেটিনার লোনাজলে তোমার সাঁতার পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার!' (পিতার পত্র)।

প্রথম বই প্রকাশের জন্য যা সময় নিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে নিলেন তার দ্বিগুণ! অবশেষে নীরবতার অবসান ঘটিয়ে ২০১৯ সালের শেষে, ৩৪ বছর পর ঠিক ৩৪টি কবিতা নিয়েই হাজির হলেন তিনি।

হেলাল হাফিজের কবিতার মোড়কে যথারীতি প্রণয় আর ভেতরে আগুন-শপথ, প্রতীক্ষা, দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও সমকালভাবনা। তার জীবনে কবি, যাপনে কবি। তার সৃষ্ট পঙক্তিমালার মর্ম ও সংবেদন, অন্তর্নিহিত লাবণ্যপ্রভা, নান্দনিক সৌরভ কবিতা প্রেমিকদের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আলোড়িত করেছে। দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও সমকাল ভাবনার সূত্র থেকে উৎসারিত তার কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য অনন্য।

হেলাল হাফিজের কবিতার সামগ্রিক পরিমিতিবোধ ও প্রায়োগিক দিকটি বেশ শক্তিশালী। গত ৪ যুগের কাছাকাছি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই কবির প্রথম ও রহস্যময় কাব্যগ্রন্থ 'যে জলে আগুন জ্বলে' বললে অত্যুক্তি হবে না। নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিতে কবিতার মানদণ্ড বিবেচিত হলেও সামাজিক মানুষ হিসেবে কবি দায়বদ্ধ সমাজের প্রতি।

তার দ্বিতীয় অণু কাব্যগ্রন্থের কবিতাও দেশ, কাল, প্রেম, দ্রোহ, সমকাল ও মানবিক পৃথিবীর নান্দনিক চেতনায় সমৃদ্ধ।

ফরাসি কবি লুই আরাগঁ বলেছেন, 'কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস'। কাব্যভাষা উন্নত, প্রবুদ্ধ ও বিকশিত চৈতন্যের ভাষা। হেলাল হাফিজের কবিতার ভাষা পাঠকের মগ্নচৈতন্যের জায়গায় আঘাত করে। কবিতা যার ঘরসংসার, প্রাত্যহিক জীবনের মৌলিক সঙ্গী, সেই কবিতায় নিজের সমস্ত জীবন নিমগ্ন ও স্বেচ্ছা সমর্পিত করলেন তিনি। জীবনের বাকি সবকিছু বিসর্জন দিয়েও শুধু এই কবিতার জন্য পুরো জীবন খরচ করেছেন। ব্যঞ্জনার সমস্ত সুর যথার্থ প্রয়োগ করে আওড়াচ্ছেন—

আপনি আমার এক জীবনের যাবতীয় সব,

আপনি আমার নীরবতার গোপন কলরব।

পরিমিতিবোধের কবি স্মার্টফোনের কবিতাকে কাব্যাকারে মলাটবন্দি করেছেন। 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' পড়তে কারো ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু, পড়ে সে আর বেরুতে পারবে না। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাবে। একটু পরেই সে আবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করবে। এই হলো দ্বিতীয় কাব্যের শক্তি। এই যে চারপাশে একটা অস্থির সময়, সমাজে হানাহানি, দুর্নীতি, অসহনশীলতা, রাজনীতির বিপথগামীতা— সেখানে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় 'বেদনাকে বলেছি কেঁদো না' কাব্যটি।

কেবলই প্রেমের কথা বলেছেন, বিরহের কথা বলেছেন, কেবলই ভালোবাসার কথা বলেছেন। প্রেমও যে প্রতিবাদের একটা ভাষা, প্রেম দিয়েও যে জয় করা যায় এবং কবিতার কোমলতায় কিছু মানুষ অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত হলেই কবির কবিতার সার্থকতা বলে কবি এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় উল্লেখ করেছেন।

চলমান অস্থির যান্ত্রিক মানুষের কৌশলী প্রেম ও সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবি অনবরত প্রেমের জয়গান গেয়েছেন, বিরহের কথা বলেছেন। বিরহ কিন্তু প্রেমেরই বড় অংশ। বিরহ মানুষকে নষ্টও করতে পারে আবার তৈরিও করতে পারে। বিরহ উপভোগের বিষয়। বিরহ ও বেদনাকে তিনি বরাবরই উপভোগ করেছেন প্রিয়তম নারীর মতো করে। তাইতো কবির উচ্চারণ—

এতো ভালোবাসা পেয়ে

ভেতর ভীষণ লাজে

বেদনারা লাল হয়ে গেছে।

কবিতার প্রতি ভালোবাসা ও পাঠকের প্রতি অসম্ভব বিনয়ী কবি সত্যিই গত ৪ দশকে ভীষণ লাজুক হয়ে আছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

3h ago