পাহাড়ি ঢল: বালু-পাথরে ভরাট নদী, ফসলি জমির ক্ষতি

sylhet_sand_9oct21.jpg
ছবি: স্টার

২০০৮ সালে জুলাই মাসে এক প্রবল বর্ষণের রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষ ওপার থেকে আসা পাহাড় ধসের শব্দ শুনতে পান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সীমান্তবর্তী খাল নয়াছড়া দিয়ে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পাথর মিশ্রিত বালুর ঢল নেমে আসে বাংলাদেশে।

সে রাতেই সীমান্তবর্তী চানপুর গ্রামের বিস্তীর্ণ কৃষি জমি, পুকুর বালিতে ভরাট হয়ে যায়। বেশ কিছু বাড়ি হাঁটু সমান বালিতে ভরে যায়। এ ছাড়া, টাঙ্গুয়ার হাওরের পঁচাশোল বিলের সঙ্গে সংযুক্ত নয়াছড়াও প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় পাথর আর চুনা বালুতে।

সেই থেকে প্রায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে একই রকম ঘটনা ঘটে আসছে। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবিদদের ভাষ্য, ভারতের মেঘালয় প্রদেশের খাসি হিল জেলাগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন এবং পাহাড় কাটার কারণে সৃষ্ট ধস এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

স্থানীয়রা বলছেন, তাহিরপুর উপজেলার চাঁনপুর, রজনী লাইন, জঙ্গলবাড়ি, চারাগাঁও, মারাম, বুরুঙ্গাছড়া এবং শান্তিপুর গ্রাম বর্ষায় বালু-পাথরের ঢলের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক ঢলে নয়াছড়া খাল ও পঁচাশোল বিল বালুতে ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া, জেলার ৩টি উপজেলার সীমান্তবর্তী মানুষের একমাত্র যাতায়াতের রাস্তা টেকেরঘাট সড়কের অনেক অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, চলতি বর্ষা মৌসুমে অন্তত ৪০০ একর জায়গা নতুন করে বালু-পাথরে ঢাকা পড়েছে। যার বেশিরভাগই কৃষিভূমি।

তাহিরপুরের শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. খসরুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আন্তঃসীমান্ত জাদুকাটা নদী ও উপজেলার পাটলাই নদী অনেকাংশে নাব্যতা হারিয়েছে ঢলের সঙ্গে আসা বালুর কারণে। এ ছাড়া, উপজেলার মাহারাম নদীও একই কারণে অনেক বছরে আগেই পুরোপুরি নাব্যতা হারিয়েছে।'

নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলনের নেতা, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য ও সীমান্তবর্তী রাজাই গ্রামের বাসিন্দা এন্ড্রু সলমার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে কয়েকবার মেঘালয়ে গেছি, ততবারই সেখানে অপরিকল্পিতভাবে কয়লা ও চুনাপাথর উত্তোলন এবং পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড় ধস হতে দেখেছি। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো।'

গত ২৩ আগস্ট বাপার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের নেতৃত্বে পরিবেশকর্মীদের একটি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শন শেষে পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা জানান, ২০০৮ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ভারত থেকে বালি ও পাথর আসা অবিলম্বে বন্ধ না হলে অচিরেই টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও কৃষিভূমি বিলীন হয়ে যাবে।

মেঘালয় রাজ্যে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে খনিজ সম্পদ আহরণ ও পাহাড় কাটা বন্ধে ভারতের সঙ্গে বিশেষ আলোচনা দরকার বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাহাড় ধসে আসা বালু-পাথর পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। কিন্তু ঠিক কতটা, তা পরিমাপ করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সেখানকার পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে আমরা চেষ্টা করবো একটা সমীক্ষা চালানোর।'

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, 'জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই এলাকায় কী পরিমাণ বালু-পাথর এসে জমেছে, তা পরিমাপের জন্য আমরা সমীক্ষা করছি।'

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নদী-হাওরসহ অন্যান্য জলাশয় ও ফসলি জমি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, 'সুনামগঞ্জ জেলার ১৪টি নদী খননের জন্য ১ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা আছে। এসব নদীর মধ্যে জাদুকাটা, মাহারাম, পাটলাই নদীও রয়েছে।'

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, 'আপাতত আন্তঃসীমান্ত জাদুকাটা নদী বা এর কোনো শাখা নদীর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগ নিলে, তার জন্য সীমান্ত এলাকায় খনন বা সংরক্ষণের কাজে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে নদী রক্ষা কমিশন বিষয়টি দেখবে।'

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এ ব্যাপারে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আপাতত আমরা চিন্তা করছি কীভাবে এসব বালু-পাথর নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা যায়। এ উদ্দেশ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে সমীক্ষাও শুরু করেছে।'

জেলা প্রশাসক জানান, ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহের ডেপুটি কমিশনার ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনে তিনি বিষয়টি উত্থাপনের চেষ্টা করবেন।

তবে আগামী সম্মেলনের তারিখ এখনো নির্ধারণ হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Scuffles in Los Angeles as soldiers sent by Trump fan out

Unrest broke out for a third day, with protesters angry at action by immigration officials that has resulted in dozens of arrests of what authorities say are illegal migrants and gang members

42m ago