মিডিয়ার ‘এজেন্ডা সেটিং ফাংশন’ ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ‘কভারেজ’

মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমার এক নায়কের ছেলে মাদক সংক্রান্ত মামলায় জেলে। গত শুক্রবার তাকে ‘কয়েদি নম্বর’ দেওয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকা এই খবর তাদের অনলাইন ভার্সনে শুক্রবার বিকেলে যখন প্রকাশ করে তার আগেই নোয়াখালীতে মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলা হয়েছে। বিবিসির খবর অনুযায়ী সেখানে হতাহতের ঘটনাও আছে। এই পত্রিকার অনলাইনে সেই খবর তখনো নেই।
প্রতীকি ছবি

মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমার এক নায়কের ছেলে মাদক সংক্রান্ত মামলায় জেলে। গত শুক্রবার তাকে 'কয়েদি নম্বর' দেওয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকা এই খবর তাদের অনলাইন ভার্সনে শুক্রবার বিকেলে যখন প্রকাশ করে তার আগেই নোয়াখালীতে মন্দিরে সংঘবদ্ধ হামলা হয়েছে। বিবিসির খবর অনুযায়ী সেখানে হতাহতের ঘটনাও আছে। এই পত্রিকার অনলাইনে সেই খবর তখনো নেই।

এই পত্রিকা বা এ দেশের পাঠকের কাছে নোয়াখালী কি মুম্বাইয়ের চেয়ে বেশি দূরে? এই আপেক্ষিক নৈকট্যের বা আপেক্ষিক দূরত্বের ব্যাখ্যা কী? এই পত্রিকাটি কোনো ব্যতিক্রম নয়। এই চিত্র গত কয়েকদিনে দেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকার এবং টেলিভিশন চ্যানেলের।

কুমিল্লায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা মণ্ডপে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ রেখে অবমাননার যে অভিযোগ, সেই গুরুতর অভিযোগের ব্যাপারে মিডিয়াতে যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধানী বা ফলোআপ রিপোর্ট এখনো দেখা যাচ্ছে না। অথচ, এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। এতো এতো ব্যাপারে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে, এই ইস্যুতে সেগুলো দেখার প্রত্যাশা অনুসন্ধিৎসু পাঠকের থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

সমাজে মিডিয়ার বিবিধ ভূমিকার একটা হচ্ছে, মানুষ কী নিয়ে কথা বলবে বা আলাপ-আলোচনা করবে সেটা নির্ধারণে ভূমিকা রাখা। প্রকাশের জন্য খবর বাছাই করার মধ্য দিয়ে এবং খবরটি কতো বড় করে, কতো দৃশ্যমান করে প্রকাশ করা হচ্ছে সেটা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে মিডিয়া এই কাজটি করে থাকে। এর সঙ্গে থাকে এসব বিষয়ে মতামত (সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি) প্রকাশ। এটাকে বলা হয় মিডিয়ার 'এজেন্ডা সেটিং ফাংশন'।

আমাদের কোনো কোনো মিডিয়া হিন্দি সিনেমার নায়কের ছেলেকে নিয়ে প্রতিদিন রিপোর্ট প্রকাশ করছে। এমনকি একই পত্রিকা একই দিনে এই বিষয়ে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে—এমন উদাহরণও আছে। এই যে একজনকে বারবার সামনে আনার মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে পাঠকের নৈকট্য সৃষ্টি, অথবা একজন সম্পর্কে খবর চেপে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জনমানস থেকে তাকে বিস্মৃত করানোর চেষ্টা—আধুনিক বিশ্বে এটাই মিডিয়ার সবচেয়ে বড় খেলা।

যেমন ধরুন, বাংলাদেশের কোনো কোনো পত্রিকায় ভারতের একটি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের খবর প্রকাশের আড়ম্বর দেখে মনে হতে পারে, এ বুঝি ঢাকার মাঠে বিশ্বকাপের খবর। সেই টুর্নামেন্টে কলকাতার দলটিকে বোঝাতে আমাদের কোনো কোনো মিডিয়া লেখে 'সাকিবের কলকাতা'। ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের একজন আমাদের সাকিব আল হাসান। তাকে নিয়ে আমাদের আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে। বাংলাদেশের মানুষের সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভারতের টুর্নামেন্টটির সঙ্গে আমাদের নৈকট্য সৃষ্টির এই প্রয়াস গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। একইভাবে 'মুস্তাফিজের রাজস্থান' ইত্যাদি লেখা হয়। একবার সেই টুর্নামেন্টের একটি দলে খেলোয়াড়দের নেট প্রাকটিসে বল থ্রোয়ার হিসেবে বাংলাদেশের দুটি ছেলে কাজ করেছিল। বাংলাদেশের কোনো কোনো পত্রিকা সেটি নিয়েও রিপোর্ট করেছিল।

এসব খবর প্রকাশ করে টুর্নামেন্টটিকে মানুষের আলোচনায় রাখা যেমন 'এজেন্ডা সেটিং ফাংশনে'র অংশ, তেমনি গত কয়েকদিনে এ দেশে বিভিন্ন মন্দিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রকাশ না করে মানুষকে সেসবের বিষয়ে আলোচনা থেকে দূরে রাখার চেষ্টাও মিডিয়ার 'এজেন্ডা সেটিং ফাংশনে'রই অংশ।

অনেকে বলে থাকেন, এক জায়গায় মন্দিরে হামলার খবর প্রকাশ হলে অন্য জায়গাতেও একই রকম হামলা হতে পারে—এ জন্য তারা খবর ছাপেন না। এই আদিকালের ধারণাটি নিয়ে আর কতোদিন আমরা চলবো? আপনার খবর প্রকাশ করা বা না করার জন্য হামলাকারীরা তো বসে নেই। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, মোবাইল ফোন আছে। যারা হামলা করবে তারা ঠিকই করছে। আপনি খবর প্রকাশ না করার অজুহাত নিয়ে বসে আছেন।

অথচ, সঠিক সংবাদ প্রকাশ করে এই সহিংসতা বন্ধে মিডিয়া অবদান রাখতে পারতো, দোষীদের চিহ্নিত করায় ভূমিকা রাখতে পারতো, সাধারণ মানুষকে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে গুজবে বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারতো।

মূলধারার মিডিয়াতে খবরগুলো আসলে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হতো তা হচ্ছে, ঘটনাগুলোর ডকুমেন্টেশন থাকতো। পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ায়, অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনতে সেগুলো সহায়ক হতো। খবর চেপে গিয়ে মিডিয়া সেই সম্ভাবনাকে আসলে সংকুচিত করছে।

এই সেন্সরশিপ কি সরকার কর্তৃক আরোপিত? তা হয়তো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই সেন্সরশিপ অনেকটাই মিডিয়া কর্তৃক স্ব-আরোপিত। এর পেছনে সরকারকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্য থাকাটা অবশ্য অস্বাভাবিক না।

প্রতিবার এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার পরে শুরু হয় রাজনৈতিক প্রশ্ন-পাল্টা প্রশ্ন। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ষড়যন্ত্রের পেছনে কে আছে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনা যায়। এ বলে ও দোষী; ও বলে এ দোষী। এবারও দেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব এই কাজটি করতে দেরী করেননি। মিডিয়া সম্ভবত বড় পদাধিকারীর বক্তব্য হিসেবে 'নেম মেকস নিউজ' তত্ত্ব মেনে সেগুলো ছেপেছে।

ঘটনা হচ্ছে, কুমিল্লাতে একটি পূজা মণ্ডপে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ রাখার ন্যাক্কারজনক কাজটি কেউ না কেউ তো করেছে। এই কাজ যে বা যারা করেছে, তার বা তাদের উদ্দেশ্য যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ সৃষ্টি তাতে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাকে বা তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কাজটি সরকারের দিক থেকে যেমন দ্রুত করা দরকার, মিডিয়াসহ বিভিন্ন পক্ষেরও সেই কাজে সহায়তা করা দরকার। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের মধ্য দিয়ে মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এরপর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে, বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে। এই যে কুমিল্লাতে একটি অপকর্ম কেউ একজন করেছে, তার জন্য অন্য জায়গায় এই ঘটনার সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন মানুষের ওপর শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। এসব বিষয়ে মিডিয়া তেমন কোনো রিপোর্ট করেনি। হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারধর, লুট—এগুলো তো ফৌজদারি অপরাধ। শুক্রবার ও শনিবারে এ দেশের মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় নেই দেশে এসব হয়েছে। বিবিসি বাংলা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। হয়তো বিদেশি বলে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, নোয়াখালীতে হামলার ঘটনার খবর যারা শুক্রবারে প্রকাশ বা প্রচার করেনি, তারা শনিবারে এসে রাজনৈতিক নেতাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের খবর প্রকাশ বা প্রচার করেছেন। ঘটনার চেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনটাই বড় খবর হয়ে গেলো!

এক জায়গায় হামলার কথা প্রকাশিত হলে অন্য জায়গায় হামলা হতে পারে, এই অনুসিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে এক জায়গায় সম্মিলিত প্রতিরোধের কথা প্রকাশিত হলে অন্য জায়গাতেও সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে উঠবে—এই চিন্তার দিকে যেতে হবে। কারণ, সমাজে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কম নয়। সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই তারা রয়েছেন। সেইসব মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও মিডিয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। এগুলো বলতে চায়, উপরের দিকে অল্পকিছু মানুষ খারাপ; আমজনতাকে তারা ভুল বোঝাচ্ছে। আমজনতা একবারে সরল সহজ, কিছুই বোঝে না, অন্যের হাতের ক্রীড়ানক—এই ধারণাটি বোধ হয় এখন আর ঠিক নয়। কথিত উপরের দিকের ষড়যন্ত্রকারী, যাদেরকে শেষমেশ কখনোই চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যায়নি এর আগের কোনো ঘটনায়, তাদের ঘাড়ে পুরো দোষ দিয়ে সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ যারা করেছেন তাদের অপরাধকে হালকা করে দেখার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। তাহলে অপরাধ করে 'গোলেমালে পার পেয়ে যাওয়া'র আশা কেউ করবে না। নিজ কৃতকর্মের দায় তাকে নিতে হবে।

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। অপরাধের খবর চেপে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। বরং খবর চেপে যাওয়াটা অপরাধীদেরকে আরও অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে গিয়ে সত্য খবর প্রকাশ না করলে একসময় আরও কলঙ্কজনকভাবে ভেঙে পড়তে পারে তথাকথিত ভাবমূর্তি। কারণ অপরাধীরাও জেনে যায়, ভাবমূর্তির পিছনে একটি আড়াল আছে। সেটি তাদের ছায়া দেবে। বরং ঘটনার সঠিক বিচার হলে অপরাধ কমে গিয়ে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে।

এ দেশের মিডিয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে শক্তিশালী ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। সত্য সংবাদকে আরও বেশি করে প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি তথ্য সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে তারা তাদের সেই ভূমিকা অব্যাহত রাখবে, এটাই কাঙ্ক্ষিত।

তাপস বড়ুয়া, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

3h ago