‘পুলিশ চলে গেলে আমাদের কী হবে?’

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রামে হামলা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের শিকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি।
সেদিনের ঘটনায় পীরগঞ্জের দরিদ্র জেলেপল্লীর বাসিন্দারা সব হারিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ৩টি গ্রামে হামলা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের শিকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি।

ঘটনার পর সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আক্রান্তদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো দেখভাল করা হচ্ছে। তারপরেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। বলছেন, পুলিশ চলে গেলে তাদের কি হবে?

এদিকে আজ মঙ্গলবার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব লক্ষ্মীপূজা।

পুড়ে যাওয়া জেলেপল্লীতে এবার লক্ষ্মীপূজার এমন কোনো আয়োজন নেই। ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি হিন্দুদের ঘরে ঘরে এই পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে হিন্দু নারীরা উপবাস ব্রত পালন করবেন। ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলবে। পূজা অর্চনার পাশাপাশি বাড়িঘরের আঙিনায় আঁকা হবে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের আলপনা।

কিন্তু পীরগঞ্জের পুড়ে যাওয়া জেলেপল্লীতে এবার লক্ষ্মীপূজার এমন কোনো আয়োজন নেই।

এবার শারদীয় দুর্গোৎসবে 'কোরআন অবমাননার' কথিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গার মন্দির-মণ্ডপে হামলা, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে গত রোববার রাত ১০টার দিকে রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বটতলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্তত ২৫টি বাড়ি-দোকানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। লুট করে নেয় সবকিছু। আক্রান্ত হয় ৬৬টি পরিবার।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। ছবি: সংগৃহীত

সেদিনের ঘটনায় পীরগঞ্জের দরিদ্র জেলেপল্লীর বাসিন্দারা সব হারিয়েছেন। তাদের পোড়া ঘরে এবার লক্ষ্মীপূজা আয়োজনের কোনো সুযোগ কিংবা সঙ্গতি নেই।

শারদীয় দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী ধনধান্যে ভরিয়ে দিতে পূজা গ্রহণ করতে আসেন।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ০৫ মিনিট থেকে পূর্ণিমা তিথি শুরু হবে। বুধবার রাত ৮টা ২৭ মিনিটে এই তিথি শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে লক্ষ্মীপূজা উদযাপন করবে হিন্দু সম্প্রদায়। শাস্ত্রমতে, দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদ তথা ঐশ্বর্যের প্রতীক।

অন্যদের মতো প্রতিবছর জেলেপল্লীর বাসিন্দাদেরও লক্ষ্মীপূজা নিয়ে আলাদা প্রস্তুতি থাকে।

অন্তত ২৫টি বাড়ি-দোকানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু এবার আর সেই অবস্থা নেই। জেলেপল্লীর বাসিন্দা সুদর্শন দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পূজা তো বছরে একবারই আসে। এ নিয়ে কত আয়োজন থাকে! কিন্তু এবার লক্ষ্মীপূজা কীভাবে হবে বুঝতে পারছি না।'

পূজার চাইতে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় তাকে। বলেন, 'এখন পুলিশ আমাদের পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশ চলে যাওয়ার পর কী হবে?'

আগুনে সর্বস্ব খোয়ানো নন্দরাণী দাসীর আগের রাত কেটেছে প্রশাসন থেকে দেওয়া তাঁবুর নিচে। তিনিও বলেন, 'বাড়িতে প্রতিবছর লক্ষ্মীপূজা হয়। এখন যে অবস্থায় আছি তাতে ইচ্ছা থাকলেও হয়তো পূজার আয়োজন করা সম্ভব হবে না।'

ঘটনার দিন বাড়িতে হামলার পাশাপাশি আরেক মৎসজীবী জগদীশ চন্দ্র দাসের ৪টি গরু লুট হয়ে যায়। প্রশাসন এর মধ্যে লুট হওয়া ১৮টি গরুর মধ্যে ৬টি গরু উদ্ধার করেছে। কিন্তু তার মধ্যে জগদীশের গরুগুলো পাওয়া যায়নি। তাই এই মুহূর্তে পূজা আয়োজনের চেয়ে গরুগুলো আদৌ ফেরত পাবেন কিনা- সেই চিন্তাতেই আকুল জগদীশ।

সেদিনের ঘটনায় পীরগঞ্জের দরিদ্র জেলেপল্লীর বাসিন্দারা সব হারিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

আগুনে সুদর্শন দাসের ২টি গরু পুড়ে মারা গেছে। এর মধ্যে ১টা গরুর দাম উঠেছিল ৩৫ হাজার টাকায়। কিন্তু সেটা তখন বিক্রি করেননি তিনি। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন। সুদর্শন বলেন, আগুন থেকে পরনের কাপড়টুকু ছাড়া আর কিছুই বাঁচাতে পারেননি তারা।

গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, তখনও বাতাসে পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

আক্রান্ত জেলেপল্লীর বাসিন্দাদের ভাষ্য, কিছু হামলাকারী মুখোশ পরা ছিল। বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার কাজটি করেছ বহিরাগতরা। আর লুটপাট চালিয়েছে স্থানীয়রা।

তারা জানান, ঘটনার দিন বিকেলে স্থানীয় একটা মসজিদ থেকে মাইকিং করে ফেসবুক পোস্ট নিয়ে করণীয় নির্ধারণে মুসলিমদের আলোচনার জন্য ডাকা হয়।

পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২টি মামলা করেছে। ১টি পোস্টদাতার বিরুদ্ধে। অন্যটি হামলা সংক্রান্ত। এতে অজ্ঞাতনামা ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

আজ দুপুর আড়াইটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, কোনো বেসরকারি সংস্থা কিংবা সরকারি দলের কোনো প্রতিনিধি  ঘটনাস্থলে যাননি।

Comments

The Daily Star  | English

Driest April in 43 years

Average rainfall in Bangladesh was one millimetre in April, which is the record lowest in the country since 1981

12h ago