মুক্তিযুদ্ধ

২১ অক্টোবর ১৯৭১: সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাবে না ভারত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২১ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে সংসদীয় পরামর্শ কমিটির সভায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা যতদিন থাকবে ততদিন ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে না।

২১ অক্টোবর ভারতীয় এক টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা বলেন, 'আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই দুই মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। ভারত আধুনিক সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ।'

ঢাকায় এদিন

২১ অক্টোবর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সহসভাপতি মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী বলেন, 'দুর্বৃত্তকারী ও দেশদ্রোহীরা উপনির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের জীবনের জন্য হুমকি। তারা এখন গুপ্ত হামলার পরিকল্পনা করছে। দেশের আজকের এই অবস্থার জন্য একমাত্র মুক্তিবাহিনী ও ভারতের চররাই দায়ী। সরকারকে এই জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রার্থীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি নির্বাচনে কোনো প্রকার পরিস্থিতির অবনতি হয় তবে পিপিপি নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হবে।'

২১ অক্টোবর ইত্তেফাক পত্রিকায় ৭৮টি জাতীয় পরিষদ আসনের পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পূর্ব পাকিস্তান হইতে জাতীয় পরিষদের ৭৮টি আসনের উপনির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র নির্বাচনী এলাকাসমূহের রিটার্নিং অফিসারগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। আগামীকাল মনোনয়নপত্রসমূহ বাছাই করা হইবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২৮শে অক্টোবর।'

পাকিস্তানে এদিন

২১ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। এসময় দুই নেতার মধ্যে উপনির্বাচন ও শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়াসহ বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের একাধিক প্রতিনিধি দল পাঠানোর বিষয়ে কথা হয়।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২১ অক্টোবর ব্রিটিশ হাউস অব কমেন্সের অধিবেশনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক্স হোম বলেন, 'পাকিস্তান তাদের সীমান্ত থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলেও ভারত এ ব্যাপারে কোনো সাড়া দেয়নি।'

এদিন মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক সিডনি শনবার্গ বলেন, 'কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গেরিলাদের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে কলকাতায় অনেক মালবাহী ট্রেন আসছে। এই অস্ত্র পরবর্তীতে গেরিলাদের হাতে পৌঁছানো হবে। ভারতের অভ্যন্তরে অনেক ট্রেনিং শিবিরে ভারতের নিয়মিত বাহিনী গেরিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। সীমান্তে বহু ভারতীয় সৈন্য এখন সতর্কতামূলক অবস্থানে রয়েছেন।'

২১ অক্টোবর আরেক মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টে, 'শান্তির জন্য হুমকি পাকিস্তান' শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, পাকিস্তানই মূলত সমগ্র অশান্তির জন্য দায়ী। যখন পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালাচ্ছে তখন মার্কিন সরকারই তাদের অস্ত্র সহায়তা, রাজনৈতিক সমর্থন, ত্রাণ সহ সমস্ত কিছু দিচ্ছে।' সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, 'ভারত ও পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত পার্থক্যের জন্য উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হয়। পাকিস্তানের নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার ফলে প্রাণের ভয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য আজ ভারত অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়েছে। যার মূল কার্বন পাকিস্তানের তৈরি শরণার্থী সমস্যা।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২১ অক্টোবর রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ফরহাদপুরে মুক্তিবাহিনীর ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত বাহিনীর দুটো দল ফরহাদপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্রিজ রক্ষার দায়িত্বে থাকা রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের দুই পাশে বিস্ফোরক লাগিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়।

২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের আমজাদনগর এলাকায় সকাল ৮টার দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ১ জন হানাদার সেনা ও তিন জন মিলিশিয়াসহ চার জন নিহত হয়। এসময় হানাদারদের এলোপাতাড়ি গুলিতে একজন বাসিন্দা নিহত হয়। একইদিন হানাদার বাহিনী ও মিলিশিয়াদের একটি দল ৫টি রিকশায় চাঁদগাজি যাওয়ার পথে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৩ হানাদার সেনা নিহত হয়।

২১ অক্টোবর নরসিংদীতে হাবিলদার আকমলের নেতৃত্বে প্রায় এক কোম্পানি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মনোহরদীতে পাকিস্তানি ঘাঁটি অবরোধ করে। এসময় হানাদারদের সহযোগী ইপিআর এর সৈনিকেরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ২৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১১ জন সেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

২১ অক্টোবর খাগড়াছড়ির রামগড়ের কাছে বড়পানুয়াতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে অ্যামবুশ করে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয়। একইদিন মিরধাবাজারে মুক্তিবাহিনীর ২ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি পেট্রলের অপেক্ষায় অ্যামবুশ করে। হানাদার বাহিনী এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনীর দলটি দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ১০ সৈন্য নিহত হয় এবং ১৫ জন আহত হয়।

২১ অক্টোবর সিলেটের শাহবাজপুরে প্রায় ৯০ জন সৈন্যের একটি হানাদার দল ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক হামলার শিকার হয়। এসময়য় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ২২ অক্টোবর ১৯৭১

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ২২ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ২২ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ২২ অক্টোবর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

South Africa win World Test Championship to end trophy drought

South Africa won the World Test Championship on Saturday, completing a remarkable turnaround to beat Australia by five wickets as they successfully chased down an imposing 282-run target.

2h ago