একজন ডা. কামরুল ও বিনা পারিশ্রমিকে ১ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন

মানবসেবার মহান ব্রত থেকেই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। পেছনে ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার অনুপ্রেরণা। সেই পথ ধরে নিজের পেশাকে কেবল সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি বানাননি তিনি। বরং দেশের দরিদ্র কিডনি রোগীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করেছেন বিশেষায়িত এক প্রতিষ্ঠান।

মানবসেবার মহান ব্রত থেকেই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। পেছনে ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার অনুপ্রেরণা। সেই পথ ধরে নিজের পেশাকে কেবল সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি বানাননি তিনি। বরং দেশের দরিদ্র কিডনি রোগীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করেছেন বিশেষায়িত এক প্রতিষ্ঠান।

সম্প্রতি ১ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপনের মাইলফলক ছুঁয়েছেন অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ও তার প্রতিষ্ঠান শ্যামলীর সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। গরীব রোগীদের কম মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন ও চিকিৎসার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেন কামরুল ইসলাম।

চলমান করোনা মহামারির মধ্যে গণস্বাস্থ্য কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ছাড়া যখন সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের অন্য সেবা কার্যক্রমগুলো বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। মহামারির দেড় বছরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ২৫০টির বেশি কিডনি। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যা দেশের অন্য যেকোনো হাসপাতালের তুলনায় বেশি।

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম ও তার ১২ সদস্যের দল গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২৫০টিরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে। ছবি: সংগৃহীত

নির্ধারিত ন্যূনতম খরচ বাদে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের কোনো ফি নেন না অধ্যাপক কামরুল। রোগীদের ফলোআপ পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ও রিপোর্ট দেখার ফিও নেওয়া হয় না তার হাসপাতালে। এ ছাড়া, খরচ কমাতে কিডনি সংরক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ধরনের দামি তরলের বিকল্প তৈরি করেছেন তিনি। এভাবে নিজ পেশার মাধ্যমে সমাজের নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছেন এই অধ্যাপক।

সেই সঙ্গে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়া, নির্ভরতা, বিশ্বস্ততা ও মমত্ববোধকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছেন তিনি।

সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অবস্থান ঢাকার শ্যামলীর ৩ নম্বর সড়কে। ৬ তলার একটি সাদামাটা ভবনে চলছে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। গত সোমবার বিকেলে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, অধ্যাপক কামরুল ইসলামের চেম্বারের সামনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীদের ভিড়। যাদের বেশিরভাগ নিম্নআয়ের মানুষ। বিকেলের শিফটে রোগী দেখার জন্য তখনও অধ্যাপক কামরুল হাসপাতালে পৌঁছাননি।

কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা যায়, এই হাসপাতালে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সেবায় ১৫ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আছে ২ জনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া ও ওষুধ খরচ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া, সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলক কম।

কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে সিকেডি হাসপাতালেই তার ব্যবস্থা আছে। আছে ২২ বেডের একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট। খরচ দেড় হাজার টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।

সহানুভূতি ও মমতার সম্পর্ক

সোমবার সন্ধ্যায় রোগী দেখতে দেখতেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসক কামরুল ইসলাম। রোগীদের সঙ্গে কথোপকথনের ভেতর দিয়েই উন্মোচিত হয় রোগীর সঙ্গে তার সহানুভূতি ও মমতার সম্পর্কের বিষয়টি।

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ৬ মাস আগে কিডনি প্রতিস্থাপন করা এক রোগী সিলেট থেকে এসেছিলেন ফলোআপের জন্য। কথোপকথনের এক পর্যায়ে অধ্যাপক কামরুল তার কাছে জানতে চাইলেন, এই বৃষ্টির মধ্যে তিনি কীভাবে যাবেন, ঢাকায় তার কোনো থাকার জায়গা আছে কিনা, দুপুরে-সন্ধ্যায় কী খেয়েছেন, কোথায় খেয়েছেন, এমন নানা কিছু। রোগের বাইরে অন্য রোগীদের ক্ষেত্রেও তার প্রশ্নের ধরণ ছিল একইরকম।

অধ্যাপক কামরুল জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীর ভালো থাকার অন্যতম শর্ত এই ফলোআপ। প্রথম দিকে প্রতি মাসে ১ বার, পরবর্তীতে ২-৩ মাস পর পর এই ফলোআপের দরকার হয়। প্রতিদিন অনেক রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে ফলোআপের জন্য আসেন।

আফসোস করে তিনি বলেন, 'এসব রোগীদের বেশিরভাগই দরিদ্র। দেখা যায় সারারাত জার্নি করে তারা ঢাকায় আসেন। সারাদিন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি যান। মাঝের সময়টাতে তাদের একটু বিশ্রাম ও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তি পেতাম। কিডনি রোগীর জন্য সেটা খুব জরুরি। কিন্তু সেই সঙ্গতি তো আমাদের নেই।'

বিনা মূল্যের ফলোআপ পরীক্ষা

অধ্যাপক কামরুল জানান, এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করা সব রোগীর ফলোআপ পরীক্ষা করা হচ্ছে বিনা মূল্যে। প্রতি মাসে এখানে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী আসেন ফলোআপ পরীক্ষার জন্য। তাদের সবার ফলোআপ বিনা মূল্যে করানো হয়। তাতে রোগী প্রতি পরীক্ষার খরচ আসে ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। এমনকি রিপোর্ট দেখতে কোনো ফি নেওয়া হয় না।

কামরুল ইসলাম বলেন, 'এই ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেওয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসতেন না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকতো।'

আগামী দিনে কিডনিদাতাদের মধ্যে কিডনি রোগ দেখা দিলে তাদেরও বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি।

করোনার মধ্যেও চলেছে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মহামারির আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, কিডনি ফাউন্ডেশন ও সিকেডি হাসপাতালে নিয়মিত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। নিয়মিত না হলেও জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। তবে মহামারি শুরু হলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরমধ্যে ব্যতিক্রম ছিল সিকেডি হাসপাতাল।

এ বিষয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, 'করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন ও ডায়ালাইসিসের কাজ বন্ধ করিনি। অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিস্থাপন বন্ধ রাখার অর্থ রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। তাই আমার মনে হয়, আমরা সঠিক কাজটিই করেছি।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদন অনুসারে, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় ৩ গুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে। অর্থাৎ করোনা মহামারির মধ্যে।

চলতি বছরের ১০ মার্চ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা যান ১০ হাজার ৬২২ জন।

জানা যায়, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত অধ্যাপক কামরুল ও তার ১২ সদস্যের দল ২৫০টিরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে।

সাফল্যের হার

সিকেডি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অধ্যাপক কামরুল ও তার দল এ পর্যন্ত যে ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে, তার মধ্যে মাত্র ৭টি কিডনি কাজ করেনি। প্রতিস্থাপনের পর বিকল হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ সফলতার হার ৯৬ শতাংশ।

এ ছাড়া, মহামারির মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ জন মারা গেছেন। আর কিডনি প্রতিস্থাপনের ২ দিন পর হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১ রোগীর।

ব্যক্তিজীবন

অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস অব এডিনবার্গ থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার 'অপরাধে' স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে।

অধ্যাপক কামরুল ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি হাসপাতাল।

তিনি ৩ কন্যা সন্তানের জনক।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দেশের কিডনি চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন অধ্যাপক কামরুল। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।

তবে তার ভাষ্য, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত যে আইন আছে, তাতে সার্জনদের প্রোটেকশন অনেক কম। এই অর্থে যে, রিলেশনশিপ যদি ঠিক না থাকে তাহলে সার্জনদের দায়ী করা হয়।

তিনি বলেন, 'এটা ঠিক না বেঠিক সেটা নির্ধারণ করা তো সার্জনদের দায়িত্ব না। তার দায়িত্ব অস্ত্রোপচার করা ও রোগীকে সুস্থ করে তোলা। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য সার্জন দায়ী থাকতে পারেন। কিন্তু আইনে রিলেশনশিপ ঠিক না থাকলে সার্জনের লাইসেন্স বাতিল ও হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের মতো বিধান আছে। এই সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য সরকারের একটা কর্তৃপক্ষ থাকলে ভালো হয়।'

এ ছাড়া, মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনের কাজে বাংলাদেশ তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি মন্তব্য করে অধ্যাপক কামরুল বলেন, 'আইসিইউতে যারা মারা যান, সেই সব মৃত ব্যক্তিদের কিডনি যদি ভালো থাকে, তাহলে তা দিয়ে ২ জন রোগীকে সুস্থ করা যায়। এই ব্যাপারটাতে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।'

আর নিজের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে মানবদরদী এই চিকিৎসকের মূল্যায়ন হচ্ছে, 'একটা মানুষের চলার জন্য খুব বেশি পয়সা তো লাগে না। যে সম্মান আমি পেয়েছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই তো অমূল্য। এটা তো আর টাকা দিয়ে পাওয়া যাবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Speed limit set for all types of vehicles

The speed limit for cars, buses, and minibuses on expressways would be 80km per hour, while it would be 60kmph for motorcycles and 50kmph for trucks.

11h ago