যে কারণে দুর্দিনের অবসান ঘটছে না

সংস্কৃতির ভেতর অনেক কিছু থাকে। শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য তো বটেই মতাদর্শও থাকে, আর ওই মতাদর্শের ব্যাপারটা মোটেই গুরুত্বহীন নয়। ওইখানে, মতাদর্শের ওই জায়গাটাতে জাতীয় কবি নজরুল ছিলেন একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামন্তবাদবিরোধী। দুই বিরোধিতার এই মিলনটা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে না, নজরুলের বেলাতে চমৎকারভাবে ঘটেছিল। ব্রিটিশ শাসনের কালে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও সামন্তবাদ বিরোধিতার ঐক্য ঘটা কঠিন ছিল। ব্রিটিশের কূটচাল তো ছিলই, হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের নেতারা, ঠাট্টা করে নজরুল যাদেরকে টিকিওয়ালা ও দাড়িওয়ালা বলেছেন, বলেছেন রামছাগল ও খোদার খাসি, তারাও তৎপর ছিল। ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে ধর্ম ঢুকে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করেছে, জন্ম দিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার, এবং পরিণতিতে সাতচল্লিশে যা ঘটেছে তা স্বাধীনতা প্রাপ্তি নয়, সেটা হলো মারাত্মক দেশভাগ।

নজরুলের নানা পরিচয় আমরা জানি। তিনি বিদ্রোহের কবি, আবার প্রেমেরও কবি। গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে। রাজনীতিতে ছিলেন। বক্তৃতা, ভাষণ, অভিভাষণ কোনো কিছুতেই উৎসাহের অভাব ছিল না। সংবাদপত্র সম্পাদনা করেছেন। কারাভোগ করেছেন কবিতা লিখে, কারাগারে অনশন করেছেন। ১৯২৩-এ, বয়স যখন চব্বিশ, তখন জেলে গেছেন, ১৯৩১-এ আবারও যেতেন, যদি গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত না হতো। কিশোর বয়সেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সৈনিক হিসেবে। অসাধারণ মানুষ একজন। কিন্তু তার আসল পরিচয় হচ্ছে এই যে, তিনি খাঁটি বাঙালি ছিলেন এবং বিশ্বাসী ছিলেন সমাজ বিপ্লবে।

বাংলা কাব্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের পরই তার স্থান; রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয় অবশ্যই নন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতোই বহুমুখী। আরেকজন মহৎ কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, এবং তিনিও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। নজরুল ও জীবনানন্দ সমসাময়িক, একই বছরে জন্ম তাদের। দুজন দুই রকমের; হতেই হবে, কেননা উভয়েই তারা মহৎ কবি; কিন্তু জীবনানন্দ দাশের আত্মপ্রকাশের কালে নজরুল এতটাই প্রবল ছিলেন যে, ১৯২৮ সালে জীবনানন্দের প্রথম কবিতার বই 'ঝরা পালক' যখন বের হলো তখন দেখা গেল যে, জীবনানন্দের কবিতায় নজরুল উপস্থিত রয়েছেন-ভাবে, এবং ভাষাতেও। জীবনানন্দ অবশ্য পরে তার নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এবং অসাধারণ হয়ে রয়েছেন। তবে দুজনের আত্মীয়তা দূর হয়নি। উভয়েই ভালবাসতেন বাংলার মানুষ, প্রকৃতি, ঐতিহ্যকে; এবং দুজনেই ছিলেন আন্তর্জাতিক, যে আন্তর্জাতিকতা না থাকলে তারা অত বড় হতেন না; আধুনিক হওয়াও সম্ভব হতো না। জীবনানন্দ আধুনিক ও প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন, নজরুলও সে কাজটি করেছেন।

তবে নজরুলের আন্তর্জাতিকতাটা ছিল ভিন্ন ধরনের। রুশ বিপ্লবের মতাদর্শিক ধারণা ও তাৎপর্যকে তিনি যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন তার আগে তো বটেই, পরেও সেভাবে অন্য কেউ গ্রহণ করতে পারেননি। অথচ কাজটা শুরু করেন তার বয়স যখন একুশ-বাইশ বছর তখনি। তিনি নিজের কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা। কুলি, মজুর, কৃষক, শ্রমিক, ধীবর, বারবনিতা, চোর, ডাকাত কেউ তার কবিতা থেকে বাদ পড়েননি।

ওই যে যার অতিপরিচিত পঙক্তিগুলো, 'সেদিন দেখিনু রেলে/কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে' সেখানে তো একথাও আছে, 'চোখ ফেটে এল জল/এমন করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?' রেলস্টেশনের ছোট ঘটনা, প্রতিনিয়ত ঘটে, ঘটছে এখনো, তা দেখে চোখে জল আসাটাও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু ওই যে প্রশ্ন: এমন করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? ওই প্রশ্ন তো ব্যাপারটাকে আর স্থানীয় রাখেনি, আন্তর্জাতিক করে তুলেছে। কেবল প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হননি, আশ্বাস দিয়েছেন, 'মহামানবের মহাবেদনার আজি মহা উত্থান/ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান।' কিন্তু কেমন করে সম্ভব হবে প্রবল পরাক্রান্ত শয়তানের পরাভব? সে পথের সন্ধানও তিনি দিয়েছেন। সম্ভব হবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তি উদ্যোগে আস্থা ছিল না, চেয়েছেন সমষ্টিগত সংগ্রাম, যে সংগ্রামে তিনি নিজেও অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন, যে জন্য রাজনৈতিক দল গড়েছেন, অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছেন, সম্পাদনা করেছেন দৈনিক পত্রিকা। প্রথম পত্রিকার নাম দিয়েছেন 'ধূমকেতু' এবং পরেরটির নাম 'লাঙল'। আকাশের ধূমকেতু এবং মাঠের লাঙলকে একসঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। যাতে বিপ্লব সম্ভব হয়।

বিপ্লবই ছিল তার স্বপ্ন। তাকে আমরা বিদ্রোহী বলে জানি, যে ঘোষণাটা তিনি নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু তার বিদ্রোহ কেবল ধূমকেতুর নয়, লাঙলেরও; অর্থাৎ কি না এটা হঠাৎ জ্বলে ওঠার নয়, ধারাবাহিক প্রবাহের বটে। লক্ষ্যটা ধ্বংসের জন্য ধ্বংস করা নয়, নতুন সৃষ্টির জন্য ধ্বংস করা। ১৯২৭ সালে ইব্রাহিম খাঁকে লেখা সেই বিখ্যাত খোলা চিঠিতে নজরুল তো বলেছেনই, 'নতুন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙি-শুধু ভাঙার জন্যই ভাঙার গান আমার নয়।' 'বিদ্রোহী' কবিতার সেই গগনবিদারী প্রচণ্ড ধ্বংসের ধ্বনির ভেতরেই তো বলে দিয়েছেন তিনি যে, তার বিদ্রোহ মোটেই উদ্দেশ্যহীন নয়, তিনি শান্তি চান, আর শান্তি চান বলেই বিদ্রোহ করেছেন, সেই শান্তি তখনই আসবে পৃথিবী যখন অত্যাচারশূন্য হবে, অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ যখন আর ভীম রণভূমে রণিবে না, জগৎ জুড়িয়া দুর্বলকে আর মার খেতে হবে না। বিপ্লব অর্থ সংস্কার নয়, স্থায়ী ও পরিপূর্ণ পরিবর্তন বটে। 'পথের-দাবী'র সেই অসামান্য নায়ক সব্যসাচীও বিপ্লবী, কিন্তু তার বিপ্লব হচ্ছে ভদ্রলোকের বিপ্লব, যে কথাটা সব্যসাচী নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। খেয়ালী শিল্পী শশীকে সব্যসাচী তার ওই বিপ্লবের জন্য গান লিখতে বলেছেন। শশীর ভেতর নজরুলের ছাপ আছে বলে মনে হয়, যদি থেকে থাকে তবে শশী আর যাই করুক, সব্যসাচীর বিপ্লবে যোগ দিতে সম্মত হবেন না, কেননা নজরুলের বিপ্লব তো সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লব কেবল সাম্রাজ্যবাদীদেরকে দেশ থেকে তাড়াবে না, দেশের ভেতরে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। এবং সেই কাজটা ভদ্রলোকদের দ্বারা হবে না, হবে সমগ্র জনগণের দ্বারা। 'ফরিয়াদ' কবিতায় নজরুল ঘোষণা দিচ্ছেন, 'শত শতাব্দীতে ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান/জয় নিপীড়িত জনগণ জয় জয়! জয় নব উত্থান।'

১৯২৯ সালে, নজরুলের বয়স যখন মাত্র তিরিশ, তখন কলকাতায় তাকে যে নাগরিক সংবর্ধনা জানানো হয় তাতে অন্যদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুও বক্তৃতা করেছিলেন। সুভাষ বসু বলেছিলেন, 'আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব সেখানেও নজরুলের গান গাওয়া হবে।' তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী আক্ষরিক অর্থেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে তেমনি কারাগারে নজরুলের গান গেয়েছে। তবে সুভাষ বসুর সঙ্গে নজরুলের একটা পার্থক্যও রয়েছে। সুভাস বসু খাঁটি বাঙালি হয়েও সারা ভারতবর্ষের রাজনীতি করেছেন। নজরুল ছিলেন বাংলার।

ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার যুদ্ধে তো তিনি ছিলেনই, যে জন্য তার অনেক বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, এবং তাকেও কারারুদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু বাঙালি যে একটি স্বতন্ত্র জাতি এই সত্যকে নজরুল যেভাবে জানতেন ও মানতেন সুভাষ বসুর পক্ষে সেভাবে জানা ও মানা সম্ভব হয়নি। সুভাষ ও নজরুল উভয়েই চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরাগী ছিলেন। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে তারা দুজনেই অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকে চিত্তরঞ্জন বুঝেছিলেন যে, বাঙালির রাজনীতিকে বাঙালির হাতেই রাখতে হবে, সর্বভারতীয় নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না, যে জন্য তার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল বাঙালির জন্য নিজস্ব রাজনীতি গড়ে তোলা। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনের অকাল মৃত্যু ঘটলে বাংলাকে স্বতন্ত্র রাখার আশা লুপ্ত হয়ে যায়, সর্বভারতীয় রাজনীতির দুই ধারা, কংগ্রেস ও লীগের দ্বারা বাহিত হয়ে এসে বাংলার রাজনীতিকে নিজেদের অংশ করে ফেলে, এবং সাম্প্রদায়িকতা ক্রমাগত উগ্র হতে থাকে। সুভাষ বসুর পক্ষেও চিত্তরঞ্জনের পথ ধরে অগ্রসর হবার উপায় থাকেনি, তিনি বাংলার নয়, সারা ভারতের নেতা হয়েছেন।

১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারপর থেকে পাকিস্তানের দাবি প্রবল হতে থাকে। বাংলা যে শেষ পর্যন্ত দুভাগ হয়ে যাবে তার আশঙ্কাও প্রবল হয়ে ওঠা শুরু করে। নজরুল অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। চরম পরিণতিটি তিনি দেখে যাননি। কিন্তু আশঙ্কা করেছেন, যে জন্য কংগ্রেস ও লীগ উভয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধেই বলেছেন। ১৯৩১ সালে 'নবযুগ' পত্রিকায় তার নিজস্ব কৌতুকবোধসহ তিনি লিখেছেন 'এক খুঁটিতে বাঁধা রামছাগল, এক খুঁটিতে বাঁধা খোদার খাসি, কারুর গলার বাঁধন টুটল না, কেউ মুক্ত হল না, অথচ তারা তাল ঠুকে এ ওকে ঢুঁস মারে। দেখে হাসি পায়।' এই দুই পক্ষের স্বার্থে ও তৎপরতায় দেশ যখন সত্যি সত্যি ভাগ হয়ে গেল নজরুল তখন অসুস্থ, সুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই কঠিন দুঃখ পেতেন। ১৯৪২-এ 'নবযুগে'-ই তিনি লিখেছিলেন, 'বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে 'বাঙালির বাংলা' সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।' লিখেছেন, 'বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে যে মন্ত্র শেখাতে হবে তা হলো বাংলাদেশ আমাদের, এখান থেকে আমরা তাড়াব পরদেশী দস্যু ও ডাকাতদের, রামা'দের গামা'দের।' বোঝা যাচ্ছে রামা গামা বলতে বুঝিয়েছেন অবাঙালি ব্যবসায়ীদের। ওই লেখাতে যে ধ্বনিটি নিয়েছিলেন সেটি হলো, 'বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।' পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে ওই ধ্বনি দিতে হয়েছে, এবং যুদ্ধে গিয়ে স্বাধীন করতে হয়েছে বিভক্ত বাংলার পাকিস্তানি অংশকে।

জাতীয়তাবাদের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাংস্কৃতিক ঐক্য, ওই লক্ষ্যে নজরুল যেভাবে কাজ করেছেন অন্যকোনো বাঙালি সংস্কৃতিসেবী তেমনভাবে করতে পারেননি। হিন্দু ও মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তিনি একটি ধারায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। ইব্রাহিম খাঁকে লেখা ওই চিঠিতেই নজরুল বলেছেন, যে কাজটি তিনি সচেতনভাবেই করেছেন। তার বক্তব্য ছিল, 'বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্যপ্রচলিত মুসলমানি শব্দ দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি ঘটেছে। তবু আমি জেনেশুনেই তা করেছি।'

নজরুলের সৌন্দর্যবুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর ও উঁচুমানের। কিন্তু শিল্পের সৌন্দর্যের চেয়েও সংস্কৃতির ঐক্যকে তিনি অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। হিন্দু দেবদেবীর নাম নেওয়ার অপরাধে তাকে 'কাফের' বলা হয়েছে, অন্যদিকে তথাকথিত মুসলমানি শব্দ ব্যবহারের কারণে তলোয়ার দিয়ে দাঁড়ি চাচছেন এমন ঠাট্টাও করা হয়েছে। নজরুল দমেননি। তিনি তার কাজ করে গেছেন। যে জন্য আমরা বাঙালিরা তার কাছে বিশেষভাবে ঋণী। দেশভাগের পর অন্নদাশঙ্কর রায় তার সেই সঙ্গতকারণে স্মরণীয় ছোট ছড়াটিতে যে বলেছিলেন, 'ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে ভাগ হয় নিকো নজরুল/ওই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে দুর্গতি তার ঘুচে যাক', সেটি বড়ই খাঁটি কথা। ওই বাঙালিটিকে ভাগ করা যায়নি। পাকিস্তানি দুর্বৃত্তরা চেষ্টা করেছিল তার রচনা থেকে তাদের দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে বাদ দেবে, পারেনি, নজরুল নজরুলই রয়ে গেছেন, এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা পেয়েছেন।

কিন্তু কেবল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী তো নন, আরও বেশি অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন এই বিপ্লবী কবি, তিনি সমাজ বিপ্লবের সাংস্কৃতিক দিশারী ছিলেন। আইনের চোখে যারা 'চোর-ডাকাত' বলে চিহ্নিত তাদেরকে নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন, এবং তাতে বলা হয়েছে, 'কে তোমায় বলে ডাকাত বন্ধু, কে তোমায় চোর বলে?/চারিদিকে বাজে ডাকাতি ডঙ্কা, চোরেরি রাজ্য চলে।' ছোট ছোট চোর-ডাকাতেরা ধরা পড়ে, বড় বড় চোর-ডাকাতেরা কর্তৃত্ব করে এই ঘটনা আজ থেকে আশি-নব্বই বছর আগে নজরুল দেখেছেন, জীবিত থাকলে এখনো যে সে দৃশ্যের অবসান ঘটেছে এমনটা তিনি বলতে পারতেন না। এর কারণ হলো অনেক কিছুই ঘটেছে বটে, কিন্তু যে সামাজিক বিপ্লবের জন্য তিনি কাজ করেছিলেন সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। নজরুল জানতেন কাজটা তার একার নয়, যে জন্য সবাইকে তিনি ডাক দিয়েছিলেন ওই কাজে যোগ দিতে। কিন্তু দেখলেন কাজটা এগুচ্ছে না, সাম্প্রদায়িকতার ভয়ঙ্কর দানব মানুষকে বিভক্ত করে ফেলছে, যে বামপন্থীদের ওপর তার ভরসা ছিল তারাও তেমনভাবে এগুতে পারছেন না।

শারীরিক মৃত্যুর বত্রিশ বছর আগেই যে তিনি মানসিকভাবে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তার পেছনে পারিবারিক শোক ও ব্যক্তিগত অভিমান কাজ করেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সমাজ এগুচ্ছে না এই বেদনাবোধও কার্যকর ছিল এমনটা ধারণা না করার কারণ নেই। তিনি একাকী হয়ে পড়েছিলেন। গানের জগতে আশ্রয় খুঁজেছিলেন, কিন্তু তার মতো মানুষের একাকীত্বের বিচ্ছিন্নতা কতটা সহ্য করা সম্ভব? যে জন্য শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন।

নজরুলের কাছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঋণটি কখনোই শোধ করা যাবে না, তেমন চেষ্টা করাটাও অপ্রয়োজনীয়, বরঞ্চ যা দরকার তা হলো ওই ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা। ওই ঋণ যত বাড়বে ততই আমরা ঋণী হব, অনুপ্রেরণা পাব, পাব পথের দিশা। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করার উপায়, একটিই, তার কাঙ্ক্ষিত সমাজ বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হওয়া, যেটা আমরা করতে পারছি না, এবং পারছি না বলেই আমাদের দুর্দিনের অবসান ঘটছে না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago