‘রোল মডেল’ বাংলাদেশ ও ‘হাড় নেই চাপ দিবেন না’

আমাদের 'উন্নয়ন'র প্রশংসা আমরা নিজেরাই করি। কখনো কখনো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও উন্নয়ন সূচকের ইতিবাচক কিছু চিত্র আসে। করোনাকালে পৃথিবীর বহু দেশের অর্থনীতি সংকটে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক মোটামুটি স্থিতিশীল। প্রবৃদ্ধির সূচকে ইতিবাচক ইঙ্গিত। কথাটা বারবার বলা হয় বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের 'রোল মডেল'।

কিছু সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। যা খুব বড় করে আলোচনায় আসে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলো বড় অর্জন। যেমন মাথাপিছু আয় সূচক নিয়ে যত তর্ক-বিতর্কই থাকুক না কেন, সত্য এই যে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা সূচক, শিশু মৃত্যুরোধ সূচকেও বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ভারত বৃহৎ দেশ, কিছু অঞ্চলের মানুষ অত্যধিক মাত্রার দরিদ্র। সেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে কি না, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এই আলোচনায় অবশ্যই সেই প্রশ্ন তুলছি না, সূচকের পক্ষেই থাকছে অবস্থান। তৈরি পোশাক রপ্তানি, মানবসম্পদ রপ্তানি, শান্তি রক্ষায় ভূমিকা, ধান-সবজি-মাছ উৎপাদনে সাফল্য বাংলাদেশের জন্যে গৌরবের। ক্ষমতাসীনরা এই কৃতিত্ব দাবি করবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই কৃতিত্ব তারা পাবেন। তাদের এই কৃতিত্ব বিবেচনায় রেখেই 'উন্নয়নের রোল মডেল' বিষয়ে কিছু কথা।

একটি দরিদ্র দেশ বা জাতি উন্নয়ন করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে, এমন বহু নজীর পৃথিবীতে আছে। তারা কোন মডেল অনুসরণ করে উন্নয়ন করেছে—বহুদূরে নয় আমাদের কাছাকাছি বা এশিয়ার কিছু দেশের প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যেতে পারে।

১৯৬৫ সালের জেলেপল্লী সিঙ্গাপুরকে লি কুয়ান ইউ বা আশির দশকের মালয়েশিয়াকে মাহাথির মুহাম্মদ উন্নয়নের কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তা না বললেও বুঝতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জাপান, ১৯৫০ সালের কোরিয়া যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নতি সারা পৃথিবীর বিস্ময়। কাছের দেশ থাইল্যান্ডের কথা বলা যায়।

দেশকে নতুন রূপে গড়ে তোলার জন্যে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নে। তৈরি করেছে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। যার ওপর ভিত্তি করে দেশগুলো পৌঁছেছে উন্নয়নের শীর্ষে। আর এই সবকিছুর জন্য তারা প্রথম যে উদ্যোগটি নিয়েছে তার নাম শিক্ষা। জাতিকে শিক্ষিত করেছে। নিজেদের শিক্ষাকে আধুনিকতম করার উদ্যোগ নিয়েছে। উচ্চ বেতন দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসেছে। মেধাবীদের ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় পাঠিয়ে পড়াশোনা করিয়ে এনেছে। তারপর আর বিদেশি বিশেষজ্ঞের দরকার পড়েনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ, আমেরিকা উড়োজাহাজ যোগাযোগে গুরুত্ব দেয়। পরাজিত জাপানের ওপর শর্ত আরোপ করা হয়, উড়োজাহাজ বানাতে পারবে না। বসে না থেকে উড়োজাহাজের গতির ট্রেন উদ্ভাবনের গবেষণা শুরু করে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত বিধ্বস্ত জাপান নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় মাত্র ১০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫৫ সালেই উচ্চগতির ট্রেন উদ্ভাবন করে ফেলে।

বিশ্বব্যাংকের থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়।

১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিকের সময় বুলেট ট্রেন উদ্বোধন করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেয় জাপান।

জাপানসহ পৃথিবীর সব দেশের উন্নয়নের অপরিহার্য পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষা। শিক্ষা-গবেষণা তাদের উন্নয়ন ধারণায় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের 'রোল মডেল' শ্লোগানে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন এখানেই যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা এশিয়ার জাপান, কোরিয়ার সঙ্গে তুলনা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ কম। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, শিক্ষায় ৪ শতাংশের কম ব্যয় করে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না।

বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ থাকে ২ শতাংশের মতো। যা দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, পাকিস্তানের চেয়ে কম।

আমরা মেধাবীদের বিদেশ থেকে পড়িয়ে আনার নীতিও অনুসরণ করি না। যারা নিজের চেষ্টায় যাচ্ছেন, ফিরে আসার কথা চিন্তা করছেন না। দেশে ফিরে যোগ্য সম্মান পাবেন, কাজের পরিবেশ-সুযোগ পাবেন, সেদিকেও সরকারের মনোযোগ নেই। উচ্চ শিক্ষায় আমেরিকায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল এগিয়ে গেছে। নেপালের অবস্থান ১১৩, বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭। আমরা শুধু পুকুর কাটা, ক্যামেরা কেনা বা খিচুরি রান্না শিখতে বিদেশে বেড়াতে যেতে আগ্রহী।

আন্তর্জাতিক কোনো র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সম্মানজনক অবস্থানে থাকে না, থাকে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

সিইওওয়ার্ল্ড (CEOWORLD) ম্যাগাজিন ২০২০ সালের সেরা শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, সেখানে ভারতের অবস্থান ৩৩, শ্রীলংকা ৭৭, পাকিস্তান ৮৩ এমন কি মিয়ানমারের নাম ছিল ৯২তম অবস্থানে। কিন্তু তালিকায় বাংলাদেশের নামই ছিল না।

দ্য ডেইলি স্টারে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করা শিক্ষক হতে চাওয়া প্রার্থীরা সংস্কৃত বলতে বা পড়তে পারেন না। সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ড. মাধবী রানী চন্দ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যে দিন দিন খারাপ হয়েছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। অনেকে মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো করে।'

শুধু সংস্কৃত বিভাগের চিত্রই এমন, মোটেই তা নয়। এটা আসলে শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রেরই প্রতিফলন।

বাংলাদেশের শিক্ষার করুণ অবস্থার চিত্র গত ২-৩ বছরের সবকটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় বারবার উঠে আসছে। গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬ নম্বরে।

গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স সূচকে ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৩ নম্বরে।

গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স সূচকে ১৩৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে ১১২ নম্বরে।

এই ৩ সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমন কি নেপালেরও নিচে।

আমরা দাবি করছি ডিজিটাল বাংলাদেশ, অথচ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমাদের ইন্টারনেট, মোবাইল ডেটার গতি সবচেয়ে কম।

এই ধীরগতির ইন্টারনেটেই খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে প্রতিপক্ষ দুটি ছাত্র সংগঠন বা একই সংগঠনের দুই পক্ষ মারামারি, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বা কাটা রাইফেল-পিস্তল-বন্দুক, দা চাপাতি নিয়ে যুদ্ধ করে? উগান্ডা থেকে নেপাল, কোথাও এমন নজীর খুঁজে পেলাম না। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ইতিহাস উগান্ডায় আছে। শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নেপাল, ভারতেও আছে। একই সংগঠনের দুই দল ছাত্রের মারামারির ফলস্বরূপ মাথার হাড় ভেঙে একজনকে 'হাড় নেই চাপ দিবেন না' লিখে লাইফ সাপোর্টে পাঠানোর নজীর কোথাও খুঁজে পেলাম না। পাকিস্তানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও দুই দল ছাত্রের কাটা রাইফেল বা দা চাপাতি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সংবাদ খুঁজে পেলাম না।

আমাদের উন্নয়নের 'রোল মডেল' দর্শনে শিক্ষা-গবেষণা গুরুত্বহীন। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, ভবন নির্মাণ। উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমরা উন্নয়ন দর্শনে মনে রাখিনি যে, অবকাঠামো উন্নয়নের সহায়ক। অবকাঠামো নিজে উন্নয়ন নয়। স্থায়ী উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য নিজস্ব দক্ষ-যোগ্য প্রযুক্তি নির্ভর মানবসম্পদ। সেই মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা-গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। অস্থায়ী ভিত্তিতে বিকল্প ভাবা যায়, বিকল্পই স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। আমরা চীনকে দিয়ে পদ্মাসেতু বানিয়ে নিলাম। কারণ আমাদের অর্থ থাকলেও দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রযুক্তি নেই। চীন বা অন্য কোনো দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে নিজস্ব মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারতাম, আয়ত্ত করতে পারতাম প্রযুক্তি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া যা করেছিল। তাহলে দ্বিতীয় পদ্মাসেতুটি নির্মাণ করতে পারতাম নিজেরাই। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন দর্শনে তা অনুপস্থিত। সেতু থেকে স্যাটেলাইট সবই আমরা করছি বিদেশিদের দিয়ে, অর্থের বিনিময়ে। প্রযুক্তি থেকে যাচ্ছে অজানা। দক্ষ মানবসম্পদ করে তোলার যে শিক্ষা তা থেকে আমাদের অবস্থান বহুদূরে।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Stocks fall on poor performance of large companies

Indexes of the stock market in Bangladesh declined yesterday on rising the day before, largely due to the poor performance of Islami Bank Bangladesh along with the large-cap and blue-chip shares amid sales pressures..Large-cap refers to shares which account for large amounts in market capi

2h ago