প্রাণীবাহিত রোগ: ভবিষ্যত মহামারি রোধে নজরদারি জরুরি

ঢাকার সাভারে বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্স থেকে ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ প্রথমবারের মতো এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বা বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ শুরু হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। এর পরের বছর দেশের বাণিজ্যিক খামারগুলোর ১৬ লাখেরও বেশি মুরগি মারা যায়।
ছবি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ঢাকার সাভারে বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্স থেকে ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ প্রথমবারের মতো এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বা বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ শুরু হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে যায়। এর পরের বছর দেশের বাণিজ্যিক খামারগুলোর ১৬ লাখেরও বেশি মুরগি মারা যায়।

ভাইরাসটির বিস্তারের কারণে ৪৭টি জেলার শতাধিক পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে বেকারত্ব বেড়ে যায় এবং আনুমানিক প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।

ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই রোগটি দেশে ৪১টি এমার্জিং অ্যান্ড রিএমার্জিং জুনোটিক ডিজিজের মধ্যে বার্ডফ্লু একটি।

প্রাণীবাহিত রোগগুলো মেরুদন্ডী প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিত হয়। এগুলো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী ও ছত্রাকের মতো ক্ষতিকারক জীবাণুর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে থাকে।

দেশে এখনও পর্যন্ত যতগুলো জুনোটিক রোগ শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে আছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, নিপা, সোয়াইন ফ্লু, অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, এইচআইভি এবং সর্বশেষ কোভিড -১৯।

আইসিডিডিআর,বি'র সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. সুকান্ত চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদিও প্রাণীবাহিত রোগগুলো ঘন ঘন সমস্যা সৃষ্টি করে না, তবে তারা মহামারি সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ বিষয়ে নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।'

এটি মোকাবালার জন্য, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা 'ওয়ান হেলথ' পদ্ধতির দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন। মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে পশুদের স্বাস্থ্য এবং তাদের মধ্যকার পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এই ধারণা থেকেই 'ওয়ান হেলথ' পদ্ধতি কাজ করে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, 'ওয়ান হেলথ' হলো এমন কর্মসূচি, নীতিমালা, আইন প্রণয়ন এবং গবেষণার নকশা ও বাস্তবায়নের একটি পদ্ধতি যেখানে একাধিক সেক্টর সংযুক্ত থাকে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করে।

ওয়ান হেলথ সেক্রেটারিয়েট ইন বাংলাদেশ-এর জাতীয় সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজ প্রাণীদের মধ্যে প্রচলিত একটি রোগ আগামীকাল মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হতে পারে। তাই, 'ওয়ান হেলথ' স্বাস্থ্য পদ্ধতির অধীনে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।'

অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ ওয়ান হেলথ হাই লেভেল এক্সপার্ট প্যানেলের ২৬ সদস্যের একজন। প্যানেলটি খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চালু করে।

অধ্যাপক দেবনাথ আরও জানান, ব্যাপকহারে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, অতি দ্রুত নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নতুন এবং পুরানো রোগের উদ্ভব ঘটছে যা প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে।

 

জনস্বাস্থ্যের হুমকি মোকাবিলায় ওয়ান হেলথ অ্যাপ্রোচ

বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়ান হেলথ পদ্ধতি কেবল প্রাণীবাহিত রোগের মোকাবিলা করতে সাহায্য করে না, বরং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, ভেক্টর-জনিত রোগ, নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা, দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাসহ বিভিন্ন ধরনের জনস্বাস্থ্যের হুমকি মোকাবিলা করতে পারে।

ওয়ান হেলথ পদ্ধতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক দেবনাথ বলেন, 'ওয়ান হেলথ নতুন কোনো ধারণা নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ মানুষ, প্রাণী এবং আমাদের পরিবেশের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া সেটির মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।'

'আমাদের বিপুল জনসংখ্যার কারণে, বাংলাদেশের জন্য এই পদ্ধতির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে,' বলেন তিনি।

২০০৮ সালে সব সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে কার্যকরভাবে সমন্বয়ের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ কার্যক্রম শুরু হয়।

ওয়ান হেলথ সেক্রেটারিয়েট ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য কৌশলগত কাঠামো এবং কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে (২০১৭-২০২১)।

এর কার্যক্রমের মাধ্যমে, প্রায় ১২টি গবেষণা ল্যাবরেটরিকে একটি নজরদারি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে।

 

সমন্বয় একটি বড় চ্যালেঞ্জ

কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে ওয়ান হেলথ কার্যক্রম শুরু হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থাকা সত্ত্বেও এটি কার্যকর করতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে।

তারা জানান, নতুন করে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন এজেন্ট শনাক্ত করার জন্য আরও সমন্বিত নজরদারি অবকাঠামো এবং মানুষ ও প্রাণী উভয়ের মধ্যেই সংক্রামক রোগের পর্যবেক্ষণ জরুরি।

অধ্যাপক দেবনাথ বলেন, 'এটি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ, কারণ আমাদের সবারই আমাদের নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থাকার অভ্যাস রয়েছে। কয়েক দশক ধরে এমনটাই চর্চা করা হয়েছে যে স্বাস্থ্য, প্রাণী, পরিবেশ ও অন্যান্য বিভিন্ন সেক্টরগুলো আলাদাভাবে কাজ করবে। এখানে সহযোগিতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।'

তার মতে, এক্ষেত্রে অবকাঠামো এবং দক্ষ মানব সম্পদের অভাবের মতো সমস্যাও রয়েছে। 

 

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments