পার্বত্য চট্টগ্রামে তীব্র পানি সংকটে জনজীবনে বিপর্যয়

‘২১ শতকে মানুষ পানির জন্যই মূলত যুদ্ধ করবে’—১৯৯৫ সালে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাজেল্ডিন। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরেজমিনে পরিদর্শন করে মনে হয়েছে, দেশের দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর পরিণতি এমনই হতে যাচ্ছে।

'২১ শতকে মানুষ পানির জন্যই মূলত যুদ্ধ করবে'—১৯৯৫ সালে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাজেল্ডিন। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরেজমিনে পরিদর্শন করে মনে হয়েছে, দেশের দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর পরিণতি এমনই হতে যাচ্ছে।

পুরো এলাকায় পানির সংকট থাকায় বাসিন্দারা বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সংকটের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদকে দায়ী করা যায় এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মতে এই সমস্যা থেকে সমগ্র অঞ্চলে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীর বাসিন্দা পিয়ান্ময় পাঙ্খুয়ার কথা বলা যায়। দোকান মালিক পিয়ান্ময় খাওয়ার পানির সংকটে গত বছর বিলাইছড়ি উপজেলার জান্দিমন গ্রামের পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে এখানে চলে এসেছেন।

৪৫ বছর বয়সী পিয়ান্ময়কে প্রতিদিন সকালে একটি পাঁচ লিটারের পানির জার কাঁধে নিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। একটি ঝর্ণা থেকে পরিবারের চার সদস্যের জন্য পানি সংগ্রহ করতেন তিনি। গত প্রায় এক দশক তিনি এই কাজ করেছেন।

গতবছর পিয়ান্ময় লক্ষ্য করেন, ঝর্ণার পানি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এতই দ্রুত যে, তিনি পানির জারটি সম্পূর্ণ ভরতেও পারছিলেন না।

পিয়ান্ময় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যতদিন সেখানে পানি ছিল, ততদিন এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতেও আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু চোখের সামনে ঝর্ণা শুকিয়ে গেল। আপনি অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঁচতে পারবেন, কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচা সম্ভব না। তাই পরিবার নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।'

পিয়ান্ময়ের মতো যারা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার, সরকারি নথিতে তাদের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে দ্য ডেইলি স্টার পার্বত্য চট্টগ্রামের ছয়টি দুর্গম অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন করে কমপক্ষে ৫০টি পরিবারের খোঁজ পেয়েছে যারা সুপেয় পানির খোঁজে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের চেয়ারম্যান অপু চৌধুরী বলেন, 'দুর্গম এলাকায় পানির সংকট এখন সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।'

রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার কয়েকশো খাল ও ঝর্ণার ওপর স্থানীয়রা পানির জন্য নির্ভর করতেন। কিন্তু এই উৎসগুলো থেকে আর আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

অপু জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বন উজাড়, পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের পানির উৎস জলাধারগুলো থেকে পাথর কেটে নেওয়ায় মূলত এই সংকট তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়। আমরা ট্রাকে করে বিভিন্ন এলাকায় পানি বিতরণ করি। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন ৬৫টি এলাকায় বন সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচারণা শুরু করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক কামাল হোসেন জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

কামালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন উজাড়ের কারণে গত ৫ বছরে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জলাশয়গুলো উধাও হয়ে গেছে, যেগুলোতে বৃষ্টির পানি ও খালবিলের অতিরিক্ত পানি জমা হতো। এর ফলে অনেক খাল ও ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে।

এ ছাড়াও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃষ্টিপাতের ধরন ইউনিমোডাল থেকে বাইমোডাল হয়ে গেছে।

ইউনিমোডাল আর্দ্র মৌসুমে এক বার প্রবল বৃষ্টিপাত হয়, অর্থাৎ বর্ষাকালে আর্দ্রতা ও শুষ্কতার চক্র একাধিকবার আসে না। তবে বাইমোডাল বর্ষাকালে দুই বার প্রবল বৃষ্টিপাত হয় এবং এর মাঝে কমপক্ষে একটি শুষ্ক মাস থাকে।

বর্ষাকালের শুরুতে অল্প কয়েকদিন বৃষ্টি হয়। এরপর মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে একটি লম্বা বিরতি দিয়ে মৌসুমের সর্বশেষ দিনের আগের দিন আবারো বৃষ্টি হয়।

রাঙ্গামাটি আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ কাজী হুমায়ুন রশিদ জানান, বৃষ্টিপাতের ধারা এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে এটি অনেক সময় পূর্বাভাষের সঙ্গে মিলছে না।

তিনি বলেন, '২০১৭ সালে অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। সে বছর ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। এতে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ভূমিধ্বস হয়। তবে পরের বছর পূর্বাভাষের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়।'

রশিদ জানান, বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে না এমন দিনের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি যোগ করেন, ২০১৯ ও ২০২০ সালের বৃষ্টিপাতের ধরন বাইমোডাল ছিল।

পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রশিদ আহমেদ জানান, তিনি ২০১৬ সালে এই পদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আবহাওয়ায় বদল দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে কৃষির ওপর। এই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর।'

তিনি জানান, নিয়মিত বৃষ্টিপাতের ওপর পার্বত্য অঞ্চলের কৃষিকাজ পুরোপুরি নির্ভরশীল। তিনি যোগ করেন, শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'তবে এই সংকট নিরসনে আরও বেশি উদ্যোগ প্রয়োজন।' উপযুক্ত উদ্যোগ না নেওয়া হলে, শিগগির আসন্ন বিপদকে প্রতিহত করার সময় ফুরিয়ে যাবে বলে মত প্রকাশ করেন রশিদ।

এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য ডেনমার্কের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সম্মিলিতভাবে ২০১৮ সালে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীলতা প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

এই প্রকল্পে বেশ কয়েক ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন: গ্র্যাভিটি ফ্লো ব্যবস্থা, ইনফিলট্রেশান গ্যালারি ব্যবস্থা, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সরবরাহ ইত্যাদি। প্রকল্প কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনের ১০টি উপজেলার মোট ১০৭টি গ্রামকে সহায়তা দেওয়া হবে।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

19h ago