৭ বছরে লাভ ৪৩ হাজার কোটি ও প্রতিবছর ভ্যাট ট্যাক্সে আয় ৯-১০ হাজার কোটি

সরকারের একাধিক মন্ত্রীর দাবি, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং প্রতিবেশী ভারতে পাচার রোধে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রস্তাবে দাম বাড়ানোর কাজটি করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। কিন্তু কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) না জানিয়ে কারসাজির মাধ্যমে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে দিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো এবং তা কার্যকর করিয়েছে বিপিসি। যা সুনির্দিষ্টভাবে বিইআরসি'র আইন লঙ্ঘন এবং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এসব বিষয় নিয়ে ক্যাব'র জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিমের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

দাম বাড়ানোর দরকার মনে করলেই সরকারের ভারতে তেল পাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'এর কোনো প্রমাণ আছে? দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে, রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এখানে কারও ব্যর্থতা থাকলে তার দায় আছে, তার শাস্তি হওয়া উচিত।'

'দেশ থেকে তেল পাচার হলে সেসব ঘটনা শোনা যেত। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোনো মন্তব্য করলে, সেটি দায়িত্বপূর্ণ হতে হয়। তেল পাচারের অভিযোগ তুললে, সেসবের প্রমাণ দিতে হয়, দলিলপত্র দেখাতে হয়, তদন্ত করতে হয়। সরকারের কাছে এসব ঘটনার কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা, আমার জানা নেই। ভারত তো এমন কথা কখনও বলে না। ভারতে তেলের দাম যখন কম, আমাদের বেশি ছিল, তখন তো ভারতের সরকার বলেনি যে, ভারত থেকে বাংলাদেশে তেল পাচার হচ্ছে', বলেন তিনি।

সরকারের দাবি, গত সাড়ে ৫ মাসে ডিজেলের জন্য বিপিসি'র প্রায় ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ মাসে ১ হাজার ১৪৭ কোটি লোকসান হলে, তার আগে বিপিসি অনেক লাভও করেছে। সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার বেশি। ট্যাক্স-ভ্যাটের বাইরে যা শুধুই মুনাফা। ট্যাক্স-ভ্যাট তো নির্ধারিত। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট থেকে প্রতিবছর ৯-১০ হাজার কোটি টাকা পায়। সরকারের সব রাজস্ব আয়ের মতো এই টাকাও কেন্দ্রীয় কোষাগারে চলে যায়।'

'বিপিসি কবে কত টাকা লাভ-লোকসান করেছে, প্রতিবছর কোষাগারে কত টাকা দিয়েছে, সরকার সেটা জানে। তবে মুনাফার ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা কোষাগারে যাওয়ার পর কোথায় ব্যয় হয়েছে, সেটি সরকার জানে না। ৭ বছর আগে সরকার জ্বালানি খাতে বছরে ৩-৭ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে আবারও দিতে হতে পারে। এ কথা ভেবে সরকার এই টাকা একটা জরুরি ফান্ড হিসেবে রেখে দিতে পারতো', বলেন তিনি।

ট্যাক্স-ভ্যাটের বাইরেও সরকারের মুনাফার বিষয়টা কী?

বুয়েটের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, 'অকটেনের দাম বাড়েনি, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকা লিটার। এই তেলের আমদানিকৃত মূল্য হয়তো ৪০-৪৫ টাকা। এর সঙ্গে নির্ধারিত ভ্যাট, ডিউটি, ট্যাক্স ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি প্রায় ৩০ টাকা। সরকার চাইলে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি করতে পারে। কিন্তু এখানে সরকার উল্টো আরও লাভ করছে।'

'সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট থেকে যে ৯-১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়, এটা আসলে নন-প্রফিট হওয়ার কথা। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট নেবেই, এটাকে আমরা মুনাফা নয়, রাজস্ব বলি। এর বাইরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন কম ছিল, তখন সরকার দেশে বেশি দামে তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে', বলেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে সরকার আসলে লাভ না লোকসানে আছে? তেলের দাম বাড়ানোর পেছনে সরকারি যুক্তির নৈতিক ভিত্তি কী?

অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, 'কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। তেলের দাম বাড়িয়ে জ্বালানি বিভাগ সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। সরকার লোকসানে নেই। সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয় ঠিকই, তবে বিপিসি'র কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট ও মুনাফা বাবদ আয়ও করে। তবে বিশ্ববাজার থেকে কত টাকায় কেনে, পরিবহন ভাড়া কত দেয় বিপিসি'র এই বিষয়টি স্বচ্ছ না। এ ক্ষেত্রে বড় আকারের দুর্নীতির অভিযোগ আছে। বিপিসি যা বলছে, আমরা তাই বিশ্বাস করছি।' 

'সরকারের লোকসানের দাবি সঠিক এবং দাম বাড়ানোর ঘোষণা যৌক্তিক কিনা, সেটি গণশুনানি হলেই নির্ধারিত হবে। তবে জ্বালানি বিভাগ গণশুনানির পথে হাঁটছে না। দাম বাড়ানোর জন্য তাদের ব্যয় খাতের সঠিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করছে না। তাই আমরাও যাচাই-বাছাই করে এগুলোর ফাঁক-ফোকর ধরিয়ে দিতে পারছি না', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Govt relieves Kuet VC, Pro-VC of duties to resolve crisis

A search committee will soon be formed to appoint new candidates to the two posts

1h ago