বিদ্রোহীদের কাছে নৌকার প্রার্থীর পরাজয় কেন

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ২০০টির বেশি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, জাবির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ২০০টির বেশি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা হেরেছেন। জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার পেছনে বিএনপি জড়িত। আওয়ামী লীগের ঘরের বিবাদ ও অভ্যন্তরীণ কলহকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহীদের জয়ী করতে সহযোগিতা করেছে বিএনপি। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। দলীয় শৃঙ্খলার ঘাটতির কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এবং টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা।

আবার দলটির কেউ কেউ মনে করছেন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে কারণগুলো বের করতে হবে। ঢালাও কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ জানতে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদের সঙ্গে।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, 'আমরা একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন চাই। যেখানে মানুষ তার পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারে। নির্বাচনের আইন অনুযায়ী দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে এবং আমাদের দল আইন মেনে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমরা সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মনোনয়ন দিয়েছি। এখানে আমাদের দল থেকে যারা মনোনয়ন পাননি তারা বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিয়েছে।'

বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, 'ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের প্রথম কারণ হচ্ছে—বিএনপি কিংবা কিছু রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে নির্বাচন বর্জন করলেও বিভিন্ন জায়গায় যেখানে বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষমতা ভালো সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। যেখানে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি ও প্রার্থী নেই সেখানে তারা আমাদের ঘরের বিবাদ ও আমাদের দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েছে। তারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট করেছে, বিদ্রোহী প্রার্থীর হয়ে মারামারি করেছে এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। এ কারণেই মূলত বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। এখানে নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতা হলে এবং বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে আসলে আমাদের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কমে যেত।'

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলার ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে এটি অবশ্যই আমি মেনে নেব। অনেক জায়গায় আমাদের দলের স্থানীয় পর্যায়ে যারা অনেক বেশি জনপ্রিয় তারা দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। অনেক জায়গায় দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, মদদ দিয়েছেন—এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য আমরা পাচ্ছি। আগামী ১৯ তারিখ আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্যের মিটিং আছে। সেই মিটিংয়ে আমরা এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করবো।'

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, 'দলের পরবর্তী মনোনয়ন পাবেন না এবং দল থেকে পদচ্যুত হবেন জেনেও অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন এবং অনেকে নির্বাচিত হচ্ছেন। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে একটি নির্মোহ গবেষণা করা প্রয়োজন।'

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, 'যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, নিশ্চয় তারা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় বা কোনো সমীকরণে নির্বাচিত হচ্ছেন। তবে সব জায়গায় একরকম চিত্র নয়। সুতরাং ঢালাও মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। একটি নির্মোহ গবেষণা করে এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে সমাজে ছড়িয়ে পড়া অসহিষ্ণুতা কমিয়ে এনে পরমতসহিষ্ণু একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সবার উপরে দেশ—এই ভাবনায় সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশ আবার পথ হারাবে।'

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'ইউপি নির্বাচন অনেক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে। যার ফলে অনেক জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'এই বিষয়ে ১৯ তারিখে একটা মিটিং আছে। সেই মিটিংয়ে আমরা সব ইউপির ফলাফল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবো। আমাদের কি কি বিচ্যুতি ছিল আমরা তা মূল্যায়ন করে দেখবো। আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের পরবর্তী ব্যবস্থা কী হবে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, 'দলীয়ভিত্তিতে যে নমিনেশন দিচ্ছে এটি নিয়ে একটা সমস্যা আছে। বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় বিদ্রোহী প্রার্থীর দিকে তাদের একটা সমর্থন থাকে। এতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বেশি সুবিধা পান। এর কারণে যে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে তা বলা যাবে না। জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ না হওয়ায় সবাই সিলেকশনে যেতে চান। নির্বাচন ছাড়া পাশ করতে চান। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি করছে।'

তিনি বলেন, 'অনেক সময় দলীয় মনোনয়ন বোর্ডকে নানাভাবে প্ররোচিত করে অনেকই প্রার্থী হন। এটিও একটি বড় সমস্যা। তাছাড়া সর্বশেষ যে চেয়ারম্যান ছিলেন তারও একটা প্রভাব আছে। কারণ মানুষ যখন সেই চেয়ারম্যান থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হয় তখন তার প্রতি আর মানুষের আস্থা থাকে না। তাই তারা বিকল্প কাউকে নির্বাচিত করেন।'

ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে কিছুটা সমস্যার ইঙ্গিত দিয়ে এই রাজনীতি বিশ্লেষক বলেন, 'আগের মতো যদি ইউপি নির্বাচন উন্মুক্ত থাকতো তাহলে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা হতো। প্রার্থীরা অনেক বেশি সচেতন থাকতেন। তারা ভাবতেন যে জনগণের কাছে তাদের যে দায়বদ্ধতা আছে তা পৌঁছে দিতে হবে। এখন মানুষ নির্বাচনের চেয়ে অন্যান্য শক্তির সঙ্গে আপোষ করে বেশি।'

তিনি আরও বলেন, 'ইউনিয়ন পর্যায়ে যে রাজনীতি হচ্ছে তা সামগ্রিকভাবে রাজনীতি বা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের হুমকি তৈরি করবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Probe body recommends removal of Sharifa’s Tale

A probe committee, formed by the education ministry, has recommended the removal of the story titled “Sharifa's Tale” from the chapter on human resemblance and difference in the seventh-grade history and social science textbook

27m ago